আজ- ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার  দুপুর ১২:১৬

অগ্নিঝরা মার্চ :: এ মাসেই উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় টাস্কফোর্স

 

দৃষ্টি নিউজ:

অগ্নিঝরা মার্চ, স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার গৌরব অর্জন করে বাঙালি জাতি। সেই গৌরবের মুকুটে এই মার্চেই যুক্ত হবে আরো একটি সাফল্যের পালক। ৪২ বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকার পর উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির প্রথম ধাপ পাড়ি দেবে বাংলাদেশ। চলতি মার্চ মাসেই স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া সম্ভাব্য দেশগুলোর তালিকা চূড়ান্ত করবে জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিল। মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের সব সূচকে অগ্রগতি হওয়ায় ওই তালিকায় বাংলাদেশের স্থান পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর তালিকায় স্থান পেলে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে পারে বাংলাদেশ। এ জন্য অবশ্য অর্ধযুগে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। চ্যালেঞ্জগুলোর বহুমাত্রিক প্রভাব মোকাবেলা করতে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাজার সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি বণ্টন ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকেও নজর দেয়ার তাগিদ দেন তারা।
এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন- যা বাংলাদেশের একার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই বিদেশি সহায়তা জরুরি। আর দেশের উন্নয়নে দীর্ঘদিন থেকেই আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে দাতারা। এখনো জিডিপিতে তাদের অবদান ১% হলেও উন্নয়ন খাতে তাদের অবদান প্রায় সিকিভাগ। তাই এসডিজিও যেহেতু দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সেহেতু তারা এ ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে আগ্রহী। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম বা বিডিএফের তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় গত ১৭-১৮ জানুয়ারি। সম্মেলনে এসডিজি সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) থেকে আর্থিক প্রাক্কলন প্রণয়ন এবং তা সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে অর্থ কোনো সমস্যা নয় বলে মন্তব্য করেছেন সফররত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রেসিডেন্ট তাকেহিকো নাকাও। তিনদিনের সফরে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানরত এডিবির প্রেসিডেন্ট বুধবার(২৮ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনাকালে এসব কথা বলেন। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তা কতটা সম্ভব- এ প্রশ্নে তাকেহিকো নাকাও বলেন, অসম্ভব নয়। তবে খুবই কঠিন। উন্নত দেশ হওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে ১০ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। আর সে জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। দেশি বিনিয়োগের পাশপাশি বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। তিনি বলেন, সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বেশ ভালোভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, অর্থনীতির অন্যান্য সূচকও ইতিবাচক। তবে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।
১৯৭৫ সাল থেকে এলডিসি’র তালিকায় থাকা বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার পর বাংলাদেশকে কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। এর বহুমাত্রিক প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে বড় আকারে দুই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর একটি হলো- স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ বহির্বিশ্ব থেকে এখন যতটা সহজ শর্তে ঋণ পায়, উন্নয়নশীল দেশ হলে সেটি পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হবে। পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে সুযোগের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে হবে। মানুষকে কেন্দ্র করেই প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ভাবতে হবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে।
অপরদিকে, ‘উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ’কে মানতে নারাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ। তিনি বলেন, এটা শুধু প্রচারণা। শুভঙ্করের ফাঁকি। বাস্তবে দেশ মোটেও উন্নয়নশীল হয়নি। কারণ জিডিপির সুফল দেশের গুটিকয়েক মানুষ ভোগ করে। বেশিরভাগ মানুষের হাতেই টাকা নেই। দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। অর্থাৎ জিডিপির সঠিক বণ্টন হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেলে বহির্বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব- এটা যেমন সত্যি, তেমনি সরকারের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন বাণিজ্য ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। এর পাশাপাশি জিডিপির টাকার বণ্টনের গরমিলে দেশের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সুবিধা কী, জানতে চাইলে সিপিডির সিনিয়র গবেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এর ফলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে দেশের। সম্মান বাড়বে। ভিয়েতনামের মতো অনেক দেশের সঙ্গে এফটিএ করতে পারবে। জিএসপি প্লাস সুবিধাও পেতে পারে। চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ সরাসরি (অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স-ওডিএ) যেসব ঋণ পায়, উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেলে সেসব ঋণের শর্ত কঠিন হবে। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এখন রপ্তানিতে বিশেষ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উন্নয়নশীল দেশে গেলে রপ্তানিতে বিশেষ ভর্তুকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব থেকে অনুদান পায়। উন্নয়নশীল দেশ হলে সে অর্থায়নও বন্ধ হবে। উন্নয়নশীল দেশ হলে জাতিসংঘে চাঁদার হার দিগুণ হবে। এ ছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণ করতে সরকারি প্রতিনিধিদল বিনা পয়সায় যাওয়ার আর সুযোগ থাকবে না।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটি (সিডিপি) প্রতি তিন বছর অন্তর এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয় পর্যালোচনা করে। প্রথম এলডিসির তালিকা করা হয় ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশ এলডিসিতে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। বর্তমানে এলডিসির মধ্যে আছে ৪৮টি দেশ। ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র চারটি দেশ এলডিসি থেকে বের হতে পেরেছে। দেশগুলো হলো- বতসোয়ানা, কেপ ভারদে, মালদ্বীপ ও সামোয়া।
জানা গেছে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে ১০ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘জাতীয় টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে গত ৩ জানুয়ারি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের শ্রেণি থেকে উত্তরণের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের জন্য নেয়া কার্যক্রম পরিবীক্ষণের জন্য সরকার ১০ সদস্যের একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করেছে। টাস্কফোর্সের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, ইআরডি সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব, বাণিজ্য সচিব, অর্থ সচিব, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী সদস্য, বিবিএসের মহাপরিচালক। ইআরডির অতিরিক্ত সচিবকে (ডিই উইং) টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এসডিজির লক্ষ্য হলো ১৬৯টি। সরকার সবগুলো সমভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে না সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে। তাই সরকার প্রাথমিকভাবে ৩৯টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও এসডিজির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হয়েছে। এসডিজি শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে বাস্তবায়নের বিষয় নয়, দেশের সব অঞ্চলে বাস্তবায়নের ওপর সরকার জোর দিচ্ছে। মার্চ মাসে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) প্রফেসর শামসুল আলম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশের সুপারিশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এলডিসি সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে না। মার্চে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে সুপারিশ করার পর ২০২১ সালে আবার সূচকগুলো পর্যালোচনা করা হবে। সেই পর্যালোচনায় উত্তীর্ণ হলে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। এরপর আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত এলডিসি হিসেবে যে সুবিধা পাওয়া যেত, উন্নত দেশগুলোতে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা তা পাওয়া যাবে। ২০২৭-এর পর অবশ্য এলডিসির কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারবে না বাংলাদেশ। ততদিনে বাংলাদেশের সক্ষমতাও অনেক বেড়ে যাবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno