আজ- ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  সন্ধ্যা ৬:০৮

টাঙ্গাইলে পশুর হাটে চোখ রাঙাচ্ছে দাম!

 

বুলবুল মল্লিক:

আসন্ন কোরবানিকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার ২৪১টি স্থায়ী ও দেড় শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাটের জন্য এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এটা গত বছরের কোরবানির চেয়ে ২১ হাজার ৫১৬টি বেশি। তারপরও হাটগুলোতে পশুর দাম আকাশচুম্বি। ৬-৭ মণ ওজনের একটি ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড়ের দাম হাকা হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। ৪-৫ মণ ওজনের ষাড় গরুর দাম হাকা হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে লালন-পালনকৃত দেশি জাতের গরুর দাম আরও বেশি।


বিভিন্ন পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, ছোট পশুর চেয়ে বড় পশুর দাম তুলনামূলকভাবে কম। ৪-৫ মণ ওজনের গরুর দাম সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সাধারণ শ্রেণির ক্রেতারা এককভাবে কোরবানির গরু কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে ২ থেকে ৭ জন মিলে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গরু কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। একই রকমভাবে মহিষ, ছাগল ও ভেড়াও হাটগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া পশুর হাটগুলোতে একটি মাঝারি সাইজের গরুর জন্য বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা এবং ক্রেতার কাছ থেকে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা খাজনা(টোল) রাখা হচ্ছে। একটি মাঝারি সাইজের ষাড় কেনার পর ক্রেতার কাছ থেকে ১-২ হাজার টাকা খাজনা গত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাছাড়া সরকারি হাটগুলোতে শুধুমাত্র ক্রেতাই খাজনা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু বিক্রেতাদের কাছ থেকেও খাজনা(টোল) নেওয়া হচ্ছে। ফলে বিক্রেতারা এক প্রকার বিরক্ত হচ্ছেন এবং বেশি টাকা খাজনা নেওয়ায় ক্রেতারা ‘বাজনার চেয়ে খাজনা বেশি’ বলে মন্তব্য করছেন।


জেলার সবচেয়ে বড় ষাড় ৫২ মণ ওজনের দেলদুয়ার উপজেলার কলেজছাত্রী হামিদা আক্তারের মানিকের দাম হাকা হচ্ছে ১৬ লাখ টাকা। গত বছর এ ষাড়টির ওজন ছিল ৪৫ মণ আর দাম চাওয়া হয় ১৫ লাখ টাকা। ঢাকার গাবতলী হাটেও উঠিয়েছিলেন কিন্তু বিক্রি হয়নি। ষাড়টি নিয়ে হামিদা আক্তার এক প্রকার বিপাকেই পড়েছেন। গত বছর বিক্রি না হওয়ায় তিনি এবার কিছুটা কম দামে হলেও ষাড়টি বিক্রি করতে চান।


পশু বিক্রেতা হারুন, রাশেদ, আবুল খায়ের, রাসেল আহাম্মেদ, আজগর আলী, নাজমুল করিম, খোদেজা বেগম, রাইশা ইসলাম, হামিদা আক্তার, আজিজ মিয়া সহ অনেকেই জানান, কোরবানির পশুর দাম গত বছরের তুলনায় বাড়েনি। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার সাথে তুলনা করলে পশুর দাম মোটেই বাড়েনি। গরু লালন-পালন ছাড়াও হাটে ওঠাতে গরুর পেছনে বাড়তি খরচ আছে। তাছাড়া বিক্রি করলেও হাটের খাজনা পরিশোধ করতে হয়।

এখন পশু লালন-পালনে ভূষি, নালি(এক প্রকার জোলা গুর), খৈল, চালের গুড়া, খড়, কাঁচা ঘাষ ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। এসবের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তারপরও এবার কোরবানির পশুর দাম বেড়েছে বলা হচ্ছে- এটা ঠিক নয়।


কোরবানির পশু ক্রেতা জহুরুল ইসলাম, আলতাফ হোসেন, হুসেইন জহুর, খান আলী জাহান, আব্দুল আজিজ মিয়া, কলিম তরফদার, আশরাফুল ইসলাম প্রমুখ জানান, বিক্রেতারা কোরবানির পশুর দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে হাকছেন।

গত বছর যে গরু ৮০-৯০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত এবার তার দাম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা হাকা হচ্ছে। তবে বড় গরুর দাম তুলনামূলকভাবে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকা গরু অর্থাৎ ৪-৬ মণ ওজনের একটি গরুর দাম হাকা হচ্ছে সর্বনি¤œ দুই লাখ টাকা। বাধ্য হয়ে তারা ২-৭জন মিলে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে(ভাগিদার) গরু কোরবানি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।


গোবিন্দাসী গরুর হাটে খাজনা(টোল) আদায়কারীরা জানায়, তারা নিয়মানুযায়ী খাজনা আদায় করছেন। কোনভাবেই অতিরিক্ত খাজনা(টোল) নিচ্ছেন না। কোরবানির গরুতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই খাজনা দিয়ে থাকেন- এটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।


জানাগেছে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় সরকারি অর্থাৎ স্থায়ী হাট রয়েছে ২৪১টি। কোরবানি উপলক্ষে জেলায় দেড় শতাধিক অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হচ্ছে। এরমধ্যে ভূঞাপুরের স্থায়ী ৯টি হাটের মধ্যে গোবিন্দাসী গরুর হাটটি সবচেয়ে বড়। ৯০ দশকে এটা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর গরুর হাট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। নানা কারণে ওই হাট এখন জৌলুস হারিয়েছে। দীর্ঘ চার বছর ধরে সরকারিভাবে খাস কালেকশন করা হচ্ছে। এছাড়া মাটিকাটা, সারপলশিয়া, শিয়ালকোল, সিরাজকান্দি, অজুর্ণা, নিকরাইল ইত্যাদি হাটগুলো প্রসিদ্ধ।


টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ২৩টি হাটের মধ্যে বেবিস্ট্যান্ড, অয়নাপুর, যুগনী, রসুলপুর, চারাবাড়ী, করটিয়া ইত্যাদি হাটগুলো পশু বেচা-কেনার জন্য অন্যতম। কালিহাতীর ২৫টি স্থায়ী হাটের মধ্যে এলেঙ্গা, মগড়া, আউলিয়াবাদ, মরিচা, বল্লা, রামপুর, পৌজান ইত্যাদি; ঘাটাইলে ১১টি হাটের মধ্যে কদমতলী, হামিদপুর, পাকুটিয়া, ব্রাক্ষ্মণশাসন, ধলাপাড়া ইত্যাদি; মধুপুরের ১৮টি হাটের মধ্যে কাকরাইদ, শোলাকুড়ি, চাপড়ী, গাংগাইর, বানরগাছি প্রভৃতি;

ধনবাড়ীর ১১টি হাটের মধ্যে মুশুদ্দি, পাইস্কা, কদমতলী, কেরামজানী প্রভৃতি; দেলদুয়ারের ১৫টি হাটের মধ্যে দেলদুয়ার, নাল্লাপাড়া, লাউহাটি, রূপসী, ফাজিলহাটী ইত্যাদি; নাগরপুরের ১৮টি হাটের মধ্যে তেবাড়িয়া চাঁদগঞ্জ, সলিমাবাদ, শাহজানী, গয়হাটা ইত্যাদি; মির্জাপুরের ৩৬টি হাটের মধ্যে দেওহাটা, ফতেপুর, জামুর্কী, মির্জাপুর ইত্যাদি প্রসিদ্ধ পশুরহাট হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া মির্জাপুর উপজেলায় ১১২টি দৈনিক বাজার রয়েছে- সেগুলোর কয়েকটিতে অস্থায়ী পশুর হাট বসানো হবে বলে স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে। সখীপুরের ৩৮টি হাটের মধ্যে দাঁড়িয়াপুরের ছিলিমপুর, কালিদাস, কচুয়া, বড় চওনা, কাইতলা, তক্তারচালা, বহেড়াতৈল, নাকশালা ইত্যাদি। এরমধ্যে কাইতলা পশুর হাটে খাজনা কম নেওয়ায় বর্তমান সময়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। বাসাইলের ১৮টি স্থায়ী হাটের মধ্যে বাসাইল, কাশিল বটতলা, মৈশাখালী, কাউলজানী, হাবলা, আইসড়া ইত্যাদি এবং গোপালপুর উপজেলার স্থায়ী ১৮টি হাটের মধ্যে নলীন, ভেঙ্গুলা, গোপালপুর, মির্জাপুর, আলমনগর ইত্যাদি হাটগুলো পশু বেচা-কেনার জন্য প্রসিদ্ধ।


এদিকে, কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ, বিকিকিনি ও পরিবহণ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের সম্মেসলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় কোরবানির চামড়া পশুর শরীর থেকে ছাড়াতে সতর্কতার সাখে বৈধ পদ্ধতি ব্যবহার ও কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে সবাইকে সচেতনতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেওয়া হয়।


জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার এক লাখ ৯১ হাজার ৯৪৩টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬৭ হাজার ৬২০টি গরু, ৩১৭টি মহিষ, এক লাখ ২০ হাজার ১৫৮টি ছাগল এবং ৩ হাজার ৮৪৬টি ভেড়া রয়েছে। গত বছর এক লাখ ৭০ হাজার ৪২৭টি পশু জেলায় কোরবানি করা হয়েছে। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় এ বছর দেড় লাখের অধিক পশু কোরবানি হবে বলে ধারণা করছে।

তারপরও গত বছরের তুলনায় এবার ২১ হাজার ৫১৬টি বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন খামারে কোরবানির পশু মোটা-তাজা করা হয়েছে। কোন কোন খামারী বস, বাংলার বস. মানিক, কালা মানিক ইত্যাদি নামে বড় জাতের(ফ্রিজিয়ান) গরু লালন-পালন করে জেলা সহ দেশে সারা ফেলে দিয়েছেন।


টাঙ্গাইল জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মো. রানা মিয়া জানান, গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় প্রায় ২৫ হাজার বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রায় তিন হাজার খামারী গরুর হাট ছাড়াও অনলাইনে বিক্রি করছেন। প্রায় খামারীই গরুর অনলাইন ভিত্তিক পেইজ খুলে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছেন। জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয়েরও একটি পেইজ রয়েছে। ক্রেতারা সেখান থেকেও পছন্দের পশুটি কিনতে পারছেন।


টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানান, যে কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মহাসড়ক সহ জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে গরু পরিবহনের ট্রাকগুলোকে পুলিশের বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি রোধে জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ সচেষ্ট রয়েছে।

জেলার গরুর হাটগুলোতে পুলিশের টহল টীম সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে জেলা পুলিশ নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno