আজ- ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  দুপুর ১২:১৯

টাঙ্গাইল পৌরসভায় কসাইখানা না থাকায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে নগরবাসী

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইল পৌরসভায় গবাদিপশু জবাইয়ের জন্য কোন কসাইখানা নেই। মাংস বিক্রেতারা শহরে যত্রতত্র ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পরীক্ষা ছাড়াই পশু জবাই করছে। পশু সম্পদ বিভাগের এ বিষয়ে কোন তদারকি নেই। ফলে পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।

জানাগেছে, ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সেনাবাহিনী পশু জবাইয়ের জন্য টাঙ্গাইল স্টেডিয়ামের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি কসাইখানা তৈরি করে। মির্জা বেলায়েত হোসেন নামে এক পৌর কর্মচারী ওই সময় পশু জবাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরে টাঙ্গাইল পৌর কর্তৃপক্ষ সেটিকেই তাদের কসাইখানা হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। কসাইখানাটি টাঙ্গাইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার জায়গায় হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালে কসাইখানাটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৯সালে পৌর কর্তৃপক্ষ শহরের পার্ক বাজারের মাংসের বাজারের পাশে ছোট আকারে একটি কসাইখানা তৈরি করে। ২০১২ সালে কসাইখানাটি ভেঙে পৌর কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়।

কিন্তু ভূমির মালিকানা নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা ভূমি অফিসের মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়ায় উন্নয়নের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকেই মাংস বিক্রেতারা ইচ্ছানুযায়ী পরীক্ষা ছাড়াই যত্রতত্র রোগাক্রান্তসহ সব ধরণের পশু জবাই করছেন। ফলে নগরবাসী ব্রুসোলেসিস ও অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হওয়া সহ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।

অথচ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যত্রতত্র পশু জবাই বন্ধ করতে ‘পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১১’ অনুযায়ী অপরাধ প্রমাণিত হলে অনূর্ধ্ব এক বছর বিনাশ্রম কারাদ- বা ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা অথবা অনূর্ধ্ব ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

নিয়মানুযায়ী জেলা পশু সম্পদ অধিদপ্তর ও পৌরসভার স্যানেটারি বিভাগ গবাদি পশু জবাই কার্যক্রম দেখভাল করবে। কিন্তু লোকবলের অভাবে জেলা পশু সম্পদ অধিদপ্তর জবাইয়ের আগে পশু পরীক্ষার জন্য কোন ভেনেটারি চিকিৎসক পাঠাতে পারেনা। পৌরসভার পক্ষ থেকে স্যানেটারি ইন্সপেক্টর খন্দকার আব্দুল কাদের সিরাজুল ইসলাম ও মাস্টাররোলের কর্মচারী মো. হাসমত আলী খালিচোখে পশু পরীক্ষা করে সনাক্তকরণ সিল দেন এবং অপর মাস্টারলোলের কর্মচারী আবুল বাসার পশু জবাই করেন। এদের মধ্যে স্যানেটারি ইন্সপেক্টর খন্দকার আব্দুল কাদের সিরাজুল ইসলাম মাঝে মধ্যে বাজারে যান। মূলত মাস্টাররোলের কর্মচারী মো. হাসমত আলীই পরীক্ষা ও সিল দেয়ার কাজটি করে থাকেন।

সরেজমিনে জানাগেছে, প্রতিদিন শহরের পার্ক বাজারে ৬০-৬৫টি, ছয়আনি বাজারে ৩০-৩২টি, বেবীস্ট্যান্ড বাজারে ১০-১২টি, বটতলা বাজারে ১৫-২০টি, সন্তোষ বাজারে ৮-১০টি, আমিন বাজারে(গোডাউন বাজার) ১০-১২টি, বৈল্যা বাজারে ৫-৬টি, সাবালিয়া পৌর বাজারে ৩০-৩৫টি গরু-মহিষ-ছাগল-খাসী-ভেড়া জবাই করা হয়। এসব বাজার ঘুরে দেখা যায়, মাংস বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো পশু জবাই করছেন। পৌর কর্তৃপক্ষের পশু জবাইয়ের নির্ধারিত ব্যক্তি আবুল বাসার রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক পশু জবাই করছেন। তার একার পক্ষে পৌর এলাকার সব বাজারে গিয়ে পশু জবাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে কসাইরা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় জবাইয়ের অধিকাংশ কাজটি করে থাকেন। বেশিরভাগ বাজারে একই বা পাশাপাশি স্থানে সব ধরণের পশু জবাই করা হয়।

শহরের বটতলা বাজারের মাংস বিক্রেতা মো. গজনবী মিঞা ও মো. কাদের মিয়া জানান, তারা প্রতিদিন পাশের লৌহজং নদীতীরে পশু জবাই শেষে ভ্যানে করে বটতলা বাজারে মাংস নিয়ে আসেন। পৌর কর্তৃপক্ষের কেউ এসে এসব পশু জবাইয়ে তদারকি করে না বলে তারা জানান।

পার্ক বাজারের মাংস ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন সকালে দোকানের সামনে খালি জায়গায় পশু জবাই করে মাংস বিক্রি করেন। কোন কোন দিন পৌরসভার একজন কর্মচারী এসে ষাঁড়-গাভী অর্থাৎ লিঙ্গ নির্ণয়ের সনাক্তকরণ চিহ্ন ‘সিল’ দিয়ে চলে যান।

পার্ক বাজারের মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া সাজু জানান, ২০১১ সালে পৌরসভার কসাইখানাটি ভেঙে দেয়ার পর থেকে তারা দোকানের আশপাশে পশু জবাই করছেন। সম্প্রতি পৌর মেয়র জামিলুর রহমান মিরন ও সহকারী কমিশনার(ভূমি) উপমা ফারিসা পার্ক বাজারে কসাইখানা নির্মাণের জায়গা পরিদর্শন করে গেছেন। তারা দ্রুত পার্ক বাজারে একটি কসাইখানা নির্মাণ করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

বিভিন্ন বাজারে রফিকুল ইসলাম, কৃষ্ণ চন্দ্র রায়, সাগর আলী, আবু জুবায়ের সহ বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানায়, এসব বাজারে পশু জবাইয়ের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। কীভাবে পশু জবাই করা হয় তা তারা জানেন না। পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় কী-না তাও তারা জানেন না। সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপর ভর করে মাংস কিনতে হয়। বাজারে নিরাপদ মাংস নিশ্চিত করতে আধুনিক কসাইখানা নির্মাণ ও জবাইয়ের আগে প্রতিটি পশু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তারা।

টাঙ্গাইল পৌরসভার স্যানেটারী ইন্সপেক্টর খন্দকার আব্দুল কাদের সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি পৌরসভায় অসুস্থ্য বা রোগাক্রান্ত পশু নির্ণয়ের দেখভাল করেন। ভেড়া বা ছাগি জবাই করে বেশি লাভের আশায় খাসি হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে কিনা তিনি তাও দেখেন। তবে পশু পরীক্ষা করে দেখার কোন যন্ত্রপাতি তাদের নেই। তাই খালিচোখে দেখেই পশু রোগাক্রান্ত কি-না তা পর্যবেক্ষণ করেন।

খোলা জায়গায় পশু জবাইয়ের ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. মো. শরীফ হোসেন জানান, খোলা জায়গায় জবাইকৃত পশুর রক্ত থেকে ব্রুসোলেসিস ও অ্যানথ্রাক্স এর মত ছোঁয়াচে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। এ রোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু সংস্পর্শে এলে সকলেই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে আ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়। ওই সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তিনি দ্রুত অত্যাধুনিক কসাইখানা নির্মাণ করার জন্য টাঙ্গাইল পৌর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা(ডিএলও) ড. মো. আবু সাঈদ সরকার জানান, পশু জবাই করার আগে ভেটেনারি চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু লোকবলের অভাবে পশু সম্পদ বিভাগের ভেটেনারি চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব হচ্ছেনা। এলডিপি প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গাইলে একটি অত্যাধুনিক কসাইখানা নির্মাণ করার প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। টাঙ্গাইল পৌর সভার মেয়রের সাথে কসাইখানা নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ বিষয়ক চুক্তি খুব শিঘ্রই সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি জানান।

টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরন জানান, এক বছর যাবত জেলা প্রশাসনের সাথে কসাইখানার স্থান নির্ধারণের বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে টাঙ্গাইল পৌরসভায় একটি অত্যাধুনিক কসাইখানা নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতি দ্রুত টাঙ্গাইল শহরে একটি অত্যাধুণিক কসাইখানা নির্মাণ শুরু হবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno