আজ- ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  রাত ১:২৯

নদী তীরের মাটিতে সড়ক ভরাটে ১৯ গ্রামে ভাঙনের শংকা

 

বুলবুল মল্লিক:

বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৩.৬ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণের কাজে পাশের নিউ ধলেশ্বরী নদী থেকে ড্রেজার বসিয়ে বালু এনে মাটি ভরাট করা হচ্ছে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমেই নদী তীরবর্তী ১৯টি গ্রামে ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।


নদী ভাঙনের আশঙ্কায় থাকা গ্রামগুলো হচ্ছে- কুর্শাবেনু, জোকারচর, কদিমহামজানী, সল্লা, দশকিয়া, হাতিয়া, আনালিয়াবাড়ী, মগড়া, ধলাটেংগর, হায়াতপুর, পাথাইলকান্দি, কুড়িঘড়িয়া, হিজুলী, এলেঙ্গা, বাঁশি, বড়বাসালিয়া, পৌলী, ফটিকজানী ও মহেলা।

জানাগেছে, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর থেকে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি জেলার যোগাযোগের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কটি পরিগণিত হয়। এতে মহাসড়কে গাড়ির চাপ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যানবাহনের তুলনায় মহাসড়কটি সম্প্রসারিত না হওয়ায় প্রায় প্রতিদিন যানজট ও দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। বিশেষ করে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। জনগুরুত্ব বিবেচনা ও প্রতিনিয়ত যানজট-দুর্ঘটনারোধে সরকার মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীতকরণের প্রকল্প হাতে নেয়।


২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলেও বর্তমানে মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চারলেন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। ফলে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত সহজেই যানবাহন চলাচল করছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনার হারও অনেক হ্রাস পেয়েছে।


কিন্তু এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত দুই লেনের মহাসড়কে ভোগান্তি রয়েছে। প্রায়ই যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনায় তাজা প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে। যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনগুলো নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছে না। যানবাহন ও গণমানুষের ভোগান্তি লাঘবে সরকার নতুন করে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত ১৩.৬ কিমি মহাসড়ক প্রায় ৬০১ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেন করার প্রকল্প গ্রহন করেছে। এলেঙ্গা থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত চার লেনের দুই পাশে সার্ভিস লেন(এসএমভিটি) থাকলেও এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত দক্ষিণপাশে একটি সার্ভিস লেন(এসএমভিটি) করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ কারণ হিসেবে মহাসড়কের উত্তর পাশের ওই অংশে রেল লাইন রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।


সড়ক বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প(প্যাকেজ-৫) ফেইজ-২ এর অধীনে আইনি প্রক্রিয়া শেষে এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপ্রান্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড। প্রায় ৬০১ কোটি টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের ১৩.৬ কিমি মহাসড়কে একটি ফ্লাইওভার, ৮টি ব্রিজ, ১০টি কালভার্ট ও দুইটি আন্ডারপাস এবং একটি সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। আগামী ২০২৪ সালে জুন মাসে কাজটি শেষ করার কথা রয়েছে।


টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) সূত্রে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার(নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের নদী খননের উত্তোলিত বালু-মাটির(ড্রেজড ম্যাটারিয়াল) পরিমাপ করে ২১টি লটে চার কোটি দুই লাখ ২৬ হাজার ১৫৩ ঘণফুট বালু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গঠিত ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটারিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

উত্তোলিত বালু-মাটি বেশিরভাগ কালিহাতী উপজেলার সীমানায় থাকায় উপজেলা প্রশাসনকে দরপত্র আহ্বানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেলক্ষে কালিহাতী উপজেলা ড্রেজিং ও ড্রেজড ম্যাটারিয়াল ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে দুই দফায় দুটি দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা ওই দরপত্রে অংশ নিয়ে নদী খননের উত্তোলিত বালু-মাটির(ড্রেজড ম্যাটারিয়াল) কিনে নিয়ে মহাসড়ক চারলেনকরণ প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।


সরেজমিনে দেখা গেছে, কার্যাদেশ(ওয়ার্কঅর্ডার) পেয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছে। দিনরাত পাইপযোগে মহাসড়ক নির্মাণের জন্য বালু-মাটি ফেলা হচ্ছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার(নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের নদী খননের উত্তোলিত বালু-মাটি(ড্রেজড ম্যাটারিয়াল) প্রশাসনের সহায়তায় স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ক্রয় করে। পরে এলাকার প্রভাবশালীদের সহায়তায় মহাসড়কে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে।

এ কাজটি করতে গিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় দফায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি বড় বড় বাল্কহেড দিয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে বালু এনে পাইপের মাধ্যমে মহাসড়কে ফেলে। বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচ দিয়ে বাল্কহেড আসার ৫-৬টি দুর্ঘটনা ঘটে হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেকে) পানি কমে যাওয়ায় বাল্কহেড যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।

এ সুযোগে অতি মুনাফার লোভে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী তাদের এবং সাধারণ মানুষের আবাদি জমির মাটি প্রভাব খাটিয়ে ক্রয় করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মহাসড়ক ভরাটে লাগাচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বালু-মাটি বিক্রি করতে গিয়ে কালিহাতী উপজেলার কুর্শাবেনু ও কদিম হামজানি মৌজায় নিউ ধলেশ্বরী নদীর পাশে সমান্তরাল প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ আরও একটি কৃত্রিম নদী খনন করে ফেলেছে।

এতেও মহাসড়কে মাটিভরাট সম্পন্ন না হওয়ায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাব-ঠিকাদার নিযুক্ত করে। সাব-ঠিকাদার বালু ব্যবসায়ীরা নিউ ধলেশ্বরী নদীতীরের জমির মালিকদের অর্থের প্রলোভনে ফেলে মাটি কেটে নিয়ে মহাসড়কে ফেলছে। আগামি জানুয়ারি মাসে নিউ ধলেশ্বরী নদীতে বাংলা ড্রেজার বসিয়ে মাটি-বালু উত্তোলনের পায়তারা করছে। এতে বর্ষা মৌসুমে নিউ ধলেশ্বরী নদীর ডান ও বাম তীরের ১৯টি গ্রামে নদী ভাঙনের আশঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে।


ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেডের স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা ৯০ লাখ ঘণফুট মাটি-বালু উপজেলা প্রশাসনের দরপত্রের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ক্রয় করেছেন। এর বাইরেও স্থানীয় অনেকে বালু-মাটি প্রকল্পের মাটিভরাটের জন্য দিচ্ছেন- তারা তা ন্যায্যমূল্যে কিনে নিচ্ছেন। তারা ড্রেজার বা নদীতীরের পাশে গভীরতা সৃষ্টি করে কোন বালু-মাটি নিচ্ছেন না। স্থানীয় লোকজন তাদের নিজস্ব সম্পত্তি থেকে বালু-মাটি কেটে বিক্রি করলে তাদের কিছু করার নেই। এছাড়া বৃহত্তর স্বার্থে উন্নয়নের জন্য কিছুটা ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে।


এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক চারলেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক(ইডি) প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম খান জানান, তাদের দায়িত্ব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া। তারপরও প্রকল্পে মাটিভরাট করতে গিয়ে ঠিকাদারের কারণে যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে তিনি লক্ষ রাখবেন। প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno