আজ- ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার  সন্ধ্যা ৬:৪৭

পাকিস্তানের ‘কসাই’ রাও ফরমান আলী :: বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা

 

ঝর্ণা মনি:

ভারতীয় বেতারে কয়েকদিন ধরেই বারবার শোনা যাচ্ছে সর্বাধিনায়ক মানেকশ’র গম্ভীর গলা, ‘পাকিস্তানি সিপাহী, হাতিয়ার ডাল দো! যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। ঢাকা শহর এখন আমার কামানের এলাকার মধ্যে। এরপর লড়াই চালাতে গেলে তোমাদের শুধু শুধু রক্তক্ষয় হবে। তোমরা হাতিয়ার নামিয়ে আত্মসমর্পণ করো, তোমাদের জীবন ও সম্মানরক্ষার দায়িত্ব আমরা নেব।’ এদিকে এই মর্মে লাখ লাখ লিফলেট ঢাকার আকাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভারতীয় বিমান, আবার বোমাও ফেলছে। বোমার আঘাতে গভর্নর হাউসের একদিক গুঁড়িয়ে গেছে।


প্রাণ বাঁচানোর জন্য গভর্নর মালেক দ্রুত পদত্যাগপত্র লিখে দলবল নিয়ে পালিয়ে এসেছেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। অন্যদিকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ঢাকা রক্ষা করার সাধ মিটে গেছে জেনারেল নিয়াজির। গলার ফাঁসটা ক্রমশ কঠিন হয়ে আসছে দেখে মরিয়া হয়ে পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ হামিদকে টেলিফোনে নিয়াজির অনুরোধ, ‘স্যার, আমি প্রেসিডেন্টের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আপনি অনুগ্রহ করে একটু উদ্যোগ নিয়ে দেখবেন, তাড়াতাড়ি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা!’


শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটা লম্বা উত্তর এলো। তাতে যুদ্ধ বন্ধ এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের জীবনরক্ষার সমস্ত রকম ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আত্মসমর্পণের কোনো কথা নেই। তবে রাও ফরমান আলীকে ডাকলেন নিয়াজি- যুদ্ধ বন্ধ চুক্তির শর্তগুলো ঠিক করার জন্য। লম্বা ছিপছিপে চেহারার ঠাণ্ডা মাথার খুনি জেনারেল ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি চুক্তির খসড়া ছাড়া আরো একটি পরিকল্পনার খসড়াও রচনা করে রেখেছিলেন।

পরাজিত সেনানায়করা চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের আগে গোপন দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলে, নিজেদের পাপের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হয়, সে দায়িত্বও নিয়েছেন তিনি, সেইসঙ্গে বাঙালিদের শেষ শিক্ষা দিতে হিটলারের চেয়েও নিকৃষ্টতম চালটি চালেন তিনি। মৃত্যুপুরীতে লাখ লাখ করোটি আর শুকনো হাড় নিয়ে যেন মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে সেজন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা আগেই করেছিলেন কুখ্যাত এই কসাই।

বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা করে রেখেছিলেন ফরমান আলী। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাংলার সবুজ ঘাসকে রক্তাক্ত করে দিতে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন শুরু করেন তিনি। শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার, সাংবাদিক, লেখক, কবিসহ সব ধরনের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যার জন্য আল বদর ও আল শামস বাহিনীকে দায়িত্ব দেন ফরমান আলী।


মহান মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল নকশা রাও ফরমান আলীর। ঢাকার পতনের পর গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। সেখানে অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা ছিল। তবে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ যৌথভাবে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে গিয়ে রাও ফরমান আলীর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারের বিবরণ পরবর্তীতে ছাপা হয়েছে ‘সেই সব পাকিস্তানী’ বইতে। সাক্ষাৎকারে বুদ্ধিজীবী নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করেন রাও ফরমান।


লাশের ওপর লাশ:


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে, সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে সকাল এগারোটায় স্নান সেরে মায়ের কাছে খাবার চেয়েছেন প্রখ্যাত নাট্যকার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। মা খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন, এমন সময় সাত-আটটি যুবক এসে তাকে ডাকে। তাদের কমান্ডার একবার অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে চান। মুনীর চৌধুরী বললেন, খাবার দেয়া হয়ে গেছে, একটু দাঁড়াও খেয়ে নিই।

ছেলেরা বলল, স্যার, আমাদের কমান্ডার ওই মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করছেন, আপনি যাবেন আর দুটো কথা বলে চলে আসবেন। বড়জোর পাঁচ মিনিট সময় লাগবে, এসে খাবেন। ছেলেগুলোর মুখের ভাষা বিনীত, কিন্তু হাতে বন্দুক, তাই তাদের ধমক দিয়ে তাড়ানো যায় না। লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা, মাথার চুল আঁচড়ানো হয়নি, সেই অবস্থায় বেরিয়ে পড়লেন মুনীর চৌধুরী, মোড়ের কাছে আসতেই আল বদর বাহিনী তার চোখমুখ বেঁধে ফেলল!


ঠিক একইভাবে ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দাতা, অধ্যাপক ধীরেন্দ্র নাথ চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, চণ্ডীচরণ বোস স্ট্রিটের বাড়ি থেকে আইনজীবী এ কে এম সিদ্দিক, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, বিজ্ঞানী আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গোপীবাগের বাসা থেকে মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান ও দুই ভাই শাহজাহান এবং করিমুজ্জামানসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে।

বাংলাপিডিয়ার হিসাবে, মুক্তিযুদ্ধে ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। রাজধানীর মিরপুরের রায়েরবাজারে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশের ওপর ফেলা হয় লাশ। এঁদো ডোবায় নিথর দেহে পড়ে রইলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। ২০১৩ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।


ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সমন্বয়ক এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান আদালতকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খানের নির্দেশনায় এবং সম্পৃক্ততায় ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড হয়েছে। মুঈনুদ্দীন ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফ ছিলেন চিফ এক্সিকিউটর।


মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা বলছেন, ২৫ মার্চের পর থেকেই সারা বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার আর হত্যা শুরু হয়েছিল। কিন্তু নভেম্বর মাস থেকে সেই কর্মকাণ্ড আরো জোরদার করে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম হাসান বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি ছিল পুরো পরিকল্পিত। এটি শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারাদেশে, গ্রামে-গঞ্জে বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার সঙ্গে জড়িতদের ধরে ধরে হত্যা করেছে। অনেকেরই আমরা ভুলে গেছি।


নিরাপত্তা পরিষদে ফের ভেটো সোভিয়েতের:

দৈনিক অমৃতবাজারের (১৫ ডিসেম্বর ’৭১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফের ভেটো দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদিন মার্কিন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি দেশ। অন্যদিকে পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপক্ষে ভোট দেয় আর ভোটদানে বিরত থাকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স।

১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সরদার শরণ সিং বলেন, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক তৎপরতা বন্ধ করলে এবং বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সমাধানের পথের দিকে এগোলে তবেই ভারত নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করবে। জাতিসংঘে মার্কিন দূত জর্জ ডব্লিউ বুশের বক্তব্য ছিল, এখানে ভারতের গভীর অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে।

সেই অভিসন্ধি আসলে কি? প্রশ্নের জবাবে সরদার শরণ সিং বলেন, আমি মার্কিন প্রতিনিধির কাছে জানতে চাই, পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা এবং ভারতের আঞ্চলিক সীমানা লঙ্ঘনের পেছনে পাকিস্তানের কী অভিসন্ধি রয়েছে তা কি আপনি বা আপনার সরকার জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেছেন?


প্রতিরোধ যুদ্ধ:

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ এর সপ্তম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড থেকে জানা যায়, এদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পাশে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। এদিকে ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতী নদী পেরিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যায় মিত্রবাহিনী। যৌথবাহিনীর আরেকটি অংশ ঢাকার উত্তর দিক থেকে ঢাকায় প্রবেশের পথ টঙ্গীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগের পাড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়।

ভারতীয় মিত্রবাহিনী হেলিকপ্টারে করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের বৈদ্যের বাজারে এসে নামে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে ৪টি কোম্পানির মধ্যে ব্রাভো ও ডেলটা কোম্পানির সংঘর্ষে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।


এদিন হানাদারমুক্ত হয় কেশবপুর, মোড়েলগঞ্জ, শাহজাদপুর, শেরপুর, শিবগঞ্জ, উল্লাপাড়া, তাড়াইল, আক্কেলপুর, পাঁচবিবি, নবীনগর, সাভার, কালিয়াকৈর, গজারিয়া, মির্জাপুর, কাউখালি, চিলমারী, দোহাজারী, নাজিরহাট ও সান্তাহার রেল জংশন।

সূত্র: ভো.কা.

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno