আজ- ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  বিকাল ৫:২৯

প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় এবার কোন কর্মসূচি নেই

 

দৃষ্টি নিউজ:

ঢাকা ও গাজীপুরের বাইরে গ্রাম বাংলার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে উঠে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়ান-সাটিয়াচড়া গ্রামে। ১৯৭১ সালের সেদিন ৩ এপ্রিল ছিল শনিবার।

এ দিনে টাঙ্গাইল ঢোকার পথে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিকামী বীর বাঙালিরা। দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করতে সেদিন তাদের কাছে তেমন অস্ত্র-শস্ত্রও ছিল না। কিন্তু মনোবল ছিল দুর্বার। সেদিনের দু:সহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন গোড়ান-সাটিয়াচড়া গ্রামের মানুষ।

রযেছে তাদের পাওয়া না পাওযার ক্ষোভ-দাবি। রাজধানীর বাইরে গ্রামবাংলার সেই প্রথম যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে এবার কোন কর্মসূচি নেয়নি কোন সংগঠন বা ব্যক্তি। দিনটি পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম দিন হওয়ায় কোন কর্মসূচি নেওয়া হয়নি বলে দাবি করছেন কেউ কেউ।


জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল জেলার প্রথম এ প্রতিরোধ যুদ্ধে সাটিয়াচড়া গ্রামের ১৯ জন, গোড়ান গ্রামের ২৬ জন, তৎকালীন ইপিআর ও পুলিশের ২৯ জন, পাকুল্লা গ্রামের ৩ জন, কাটরা গ্রামের ১ জন, কালিহাতীর ২ জন ও অজ্ঞাত ৫১ জনসহ মোট ১৩১ জন মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হন। এছাড়া প্রায় ৩০০ জন পাকিস্তানী হানাদার নিহত এবং আহত হন সহ¯্রাধিক। হানাদাররা জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয় কয়েকটি গ্রাম। ধর্ষিত হন কয়েকজন মা বোন।


১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালি জাতি স্বাধীনতার নেশায় বিভোর হয়ে উঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলেও গঠন করা হয় সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ। যার আহ্বায়ক ও সর্বাধিনায়ক ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।

২ এপ্রিল নেতৃবৃন্দ জানতে পারেন পাকিস্তানী হানাদাররা এ রাস্তা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্রের সাজোয়া গাড়িবহর নিয়ে টাঙ্গাইলে ঢুকবে। তারপর থেকেই শুরু হয় ছাত্র-জনতা ও ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি। যুদ্ধের স্থান নির্ণয় করা হয় সড়ক সংলগ্ন গোড়ান-সাটিয়াচড়ায়। এছাড়া ধল্লা ও নাটিয়াপাড়ায়ও অবস্থান নেয় প্রতিরোধকারীরা।


এ প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন মির্জাপুরের তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য একুশে পদকপ্রাপ্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক। তিনি বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তমও এ যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।


সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতু-ঢাকা মহাসড়কে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্লা বাসস্ট্যান্ডের অদূরে এ প্রতিরোধ যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে একটি সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। যার ব্যয় ৩৩ লাখ ২১ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু সৌধটি অধিকাংশ সময় তালাবন্ধ থাকে।

এখানে জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত কমপ্লেক্সের ভেতরে বখাটেদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। শহীদদের নামের তালিকা দেওয়াল থেকে উঠে গেছে। এছাড়া স্বাধীনতার ৫১ বছরেও এখানকার বদ্ধভূমি এবং শহীদদের গণকবর সংরক্ষণ করা হয়নি। গ্রামের ভেতরের চিহিৃত কয়েকটি গণকবর ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে গেছে।

প্রতি বছর ৩ এপ্রিল দিবসটি স্মরণ করে গ্রামবাসীসহ বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু এবার দিবসটি মাহে রমজানের প্রথম দিনে হওয়ায় তেমন কোন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়নি।


যুদ্ধাহত সাটিয়াচড়া গ্রামের আব্দুল লতিফ মিয়া(৭৫) বলেন, আমার পেটে গুলির দাগ আজও রয়েছে। মাঝে মধ্যেই পেটে ব্যাথা পাই। সেদিন গুলি লেগে মরার মতো পড়ে ছিলাম। যুদ্ধ শেষ হলে স্বজনরা মির্জাপুর হাসপাতালে নিয়ে প্রাণ বাচাঁয়। গানু শিকদারের বয়স ৯০ বছর। তার বাম হাতে গুলি লাগে। তিনি সে হাত দিয়ে কাজ করতে পারেন না।

গানু শিকদারের ভাই লেবু শিকদার যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মওলানা জামাল উদ্দিনের(৭০) পিঠে ও কোমড়ে গুলি লাগায় বাঁকা হয়ে হাটেন। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে বাংকার খোড়া হয়। আমরা ইপিআর ও মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেই। যুদ্ধে আমার বড় ভাই শহীদ হন এবং বাবা পঙ্গু হয়ে মারা যান। যুদ্ধাহত হওয়ায় স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে একটি চিঠিসহ ৫০০ টাকার চেক দিয়েছিলেন। সেটা সযত্নে রেখে দিয়েছি।

জীবনের শেষ সময়ে এসে যুদ্ধাহত এ তিনজন সরকারের কাছে দাবি করে বলেন, আমরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছি। আমরা কি পেলাম ? সরকারি স্বীকৃতি চাই। সরকার আমাদের জন্য কিছু করুক।


টাঙ্গাইলের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম বদরুল আলম(৭০) বলেন, আমরা ফজলুর রহমান খান ফারুক ভাইয়ের নেতৃত্বে সশরীরে সেই যুদ্ধে অংশ নেই। ২ এপ্রিল রাতভর চলে বাংকার করাসহ নানা প্রস্তুতি। সুবেদার আব্দুল আজিজ আমাদের গাইড করতেন। পরিকল্পনা ছিল টাঙ্গাইল ঢোকার পথে সাটিয়াচড়া এবং নাটিয়াপাড়ার মাঝখানে হানাদারদের ফেলে আক্রমণ করা।

৩ এপ্রিল ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় তুমুল প্রতিরোধ যুদ্ধ। প্রতিরোধের মুখে এক পর্যায়ে হানাদাররা আকাশ থেকে আক্রমন করতে থাকে। আমাদের গোলা-বারুদ শেষ হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। এরপর হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে ঢুকে গুলি করে পাখির মতো নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে দেয় শত শত বাড়ি ঘর। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় এলাকা। বিকালের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হয় পাকিরা।


প্রতিরোধ যোদ্ধা গোড়ান গ্রামের আবু মতিন ফাক্কন বলেন, যুদ্ধের দুর্বিষহ স্মৃতি এখনও জ¦ল জ¦ল করে চোখের সামনে ভাসে। হানাদারদের ধ্বংসলীলার পর গ্রামের মানুষের ভয়াবহ কষ্ট চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো কঠিন। আমরা চাই এ যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস-তথ্য সরকারিভাবে সংরক্ষিত হোক। যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে।


প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ স্মৃতি সংসদের সভাপতি গোলাম নওজব পাওয়ার চৌধুরী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের এ স্থানে শহীদদের স্মরণে প্রতিবছর নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এবার দিনটি পবিত্র মাহে রমজামের প্রথম দিনে হওয়ায় তেমন কোন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়নি। এ উপলক্ষে পরে সুবিধাজনক সময়ে কর্মসূচি পালন করা হবে।


তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সাটিয়াচড়া ও গোড়ান গ্রাম দুটিকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণার কাঙিত উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন আজও হয় নি। আমরা চাই বদ্ধভূমি ও গণকবরগুলো শনাক্ত করে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হোক। প্রতিরোধ যুদ্ধে যারা শহীদ, যুদ্ধাহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া হোক।


টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ডক্টর মো. আতাউল গণি বলেন, গোড়ান-সাটিয়াচড়া প্রতিরোধ যুদ্ধটি মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। এর ইতিহাস রক্ষার্থে সরকারিভাবে পর্যায়ক্রমে গণকবর ও বদ্ধভূমি সংক্ষণসহ নানা উদ্যোগে গ্রহন করা হবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno