আজ- ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  দুপুর ১২:২০

বাঁধ ভেঙে আড়াইশ’ কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা!

 

বুলবুল মল্লিক:

বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর সোয়া কিলোমিটার দক্ষিণে ২৩৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকায় ১৫৩০মিটার গাইড বাঁধ(অফটেক বাঁধাই) নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। ফলে বেলটিয়াবাড়ী অংশে আগে ভেঙে যাওয়া তীরের স্থান আগামি বর্ষায় প্রসারিত হয়ে পুরো প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।


বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গড়িমসিতে শুস্ক মৌসুমে কাজ শুরু না করায় এ আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে সোমবার(৭ ফেব্রুয়ারি) বিকালে পাউবো’র প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মতিন সরকার ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান সহ পাউবো’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে দ্রুত কাজ শুরু করার জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরুরি নির্দেশ দিয়েছেন।


জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার(নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেক) খনন ও গাইড বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে।

টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের বেলটিয়া ও হাটবাড়ী আলিপুর অংশে চারটি লটে ভাগ করে পৃথক চারটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ১৫৩০মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করছে।

২০২১ সালের ৩০ জুন কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানই কাজ শেষ করতে পারেনি। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানই প্রকল্প এলাকায় এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করেনি। সাইটে তাদের কর্মচারীরা বসে বসে অলস সময় পার করছে।


স্থানীয়রা জানায়, গাইড বাঁধ নির্মাণ শুরু হওয়ায় বেলটিয়া ও হাট আলিপুর এলাকার নদীতে ঘরহারা মানুষ ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে শুরু করেছে। অনেকে বাড়িঘর নির্মাণ করছে। কেউ কেউ ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে চাইলেও গাইড বাঁধ নির্মাণ শেষ না হওয়ায় পুনরায় যমুনার ভাঙনের আশঙ্কায় বিরত রয়েছেন।

তাদের মতে, বর্তমানে যমুনার পানি সবচেয়ে নিচে(তলানীতে) রয়েছে। এখনই নদীর তলদেশে ও গাইড বাঁধ নির্মাণের উপযুক্ত সময়। এখন কাজ না করলে পানি বাড়তে শুরু করলে আর নিচের অংশে কাজ করা সম্ভব হবেনা। ফলে উপরের অংশে কাজ করা হলেও যমুনার ঘুর্ণাবর্ত স্রোতে ধ্বসে যাবে।


স্থানীয়রা আরও জানায়, দুই বছর আগে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ(বাসেক) ও পাউবো’র নদীতীর সীমানায় বেলটিয়াবাড়ীর অংশে ভাঙনের ফলে বিশালাকার পুকুর তৈরি হয়েছে। ওই স্থানে জিও ব্যাগ ও সিমেণ্টের তৈরি ব্লক ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়েছে।

বর্ষা মৌসুমে যমুনা ক্ষেপে গেলে ওই স্থান দিয়ে পৃথক নদীমুখ বের করে নিতে পারে। এতে বেলটিয়া ও কুর্শাবেনু গ্রামের দুই হাজার পরিবার ভাঙনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


টাঙ্গাইল পাউবো সূত্রে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/2017-18, লট নং-০১) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের বামতীরে বেলটিয়া অংশে ৪৫০মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে ঢাকাস্থ এসএস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৫৬ কোটি ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে বিগত ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কাজ শুরু করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিনেও প্রতিষ্ঠানটি বেলটিয়ায় কাজ করেনি।

গত অর্থবছর কাজ শুরু করে মোট কাজের ৭২ শতাংশ শেষ করে প্রায় ৬৫ শতাংশের বিল উত্তোলন করেছে। বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রকল্প এলাকায় এখনও কাজ শুরু করেনি।


প্রকল্পের (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/2017-18, লট নং-০২) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের বামতীরে বেলটিয়া অংশে ১৭৮মিটার টার্নিং সহ ৩২৮মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে ঢাকাস্থ এআরকেএল ও কিউএইচএমসিএল জয়েন্টভেঞ্চার(jv) কোম্পানী। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৬১ কোটি ১৯ লাখ ২২ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর কাজ শুরু করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিনেও সাইটে আসেনি।

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে বেলটিয়া অংশে কাজ শুরু করে। গত বছরের ৩০ জুনের মধ্যে তারা ৮২ শতাংশ কাজ শেষ করে প্রায় ৭৮ শতাংশ কজের বিল উত্তোলন করেছে। বাকি কাজ শেষ করার জন্য চলতি বছরের আগামি ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।

তারাও এখনও পর্যন্ত সাইটে আসেনি। সাইটে অবস্থানরত শ্রমিকরা একটি ভেকু দিয়ে সিমেণ্টের ব্লক নামানোর রাস্তা তৈরি করছে মাত্র।


পাউবো’র প্রকল্পের (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/20-21, লট নং-০৩) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের দক্ষিণে ডানতীরে হাটবাড়ী আলিপুর অংশে ৩৭০মিটার গাইড বাঁধের ৯৭ শতাংশ সম্পন্ন করে ৯৫ শতাংশের বিল উত্তোলন করা হয়েছে। কাজটি করে ঢাকার বিজয় নগরস্থ আকরাম টাওয়ারের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এলএ-টিটিএসএল জয়েন্টভেঞ্চারে(jv) বাঁধ নির্মাণের কাজটি করে।


প্রকল্পের (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/2017-18, লট নং-০৪) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের ডানতীরে হাটবাড়ী আলিপুর অংশে ৩৮২মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে কাজ করে ঢাকাস্থ কেএসএ ও এলএ জয়েন্টভেঞ্চার(jv) কোম্পানী। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি গত মৌসুমে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেকে) হাটবাড়ী আলিপুর অংশে ৯৯শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে ৯৫শতাংশের বিল উত্তোলন করেছে। ৩ ও ৪ নম্বর লটের বাকি কাজও আগামি ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার জন্য সর্বশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।


সরেজমিনে দেখা গেছে, যমুনার বাম তীরে চারটি লটের মাধ্যমে নিচের অংশে ঘুর্ণাবর্ত স্রোত নিয়ন্ত্রণে গত মৌসুমে মাঝারি আকারের পাথর ও সিমেণ্টের তৈরি ব্লক ফেলে ৩৩মিটার প্রস্থে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। গেল বর্ষায় ১ নম্বর লটের কিছু অংশে ভাঙনের ফলে সিমেণ্টের ব্লক ধ্বসে গেছে।

১ ও ২ নম্বর লটের গাইড বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় বেলটিয়াবাড়ী অংশে নদীতীর ভেঙে বিশালাকার পুকুর তৈরি হয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নির্মিতব্য ওই বাঁধ ধ্বসে আশপাশের গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছে যমুনা তীরবর্তী এলাকাবাসী।

তারা বাঁধ নির্মাণে এখনই কাজ শুরু করার দাবি করেছে। আগামি বর্ষার আগে নির্মাণ কাজ শেষ না হলে যমুনা ও নিউ ধলেশ্বরী নদীতে ব্যাপক আকারে ভাঙন শুরু হবে। এতে পুরো প্রকল্পটিই ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।


প্রকল্পের ২ নম্বর লটের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার রুবায়েতুল ইসলাম তন্ময় মোবাইল ফোনে জানান, তাদের অংশের কাজ শেষ পর্যায়ে। রাস্তার কাজ বাকি রয়েছে, কিন্তু মস্থানীয় লোকজন রাস্তার কাজে বাঁধা দেওয়ায় করা সম্ভব হচ্ছেনা।

পাউবো উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয়দের বিষয়টি সমাধান করা হলে দ্রুত কাজ শেষ করবেন। এছাড়া নদীতীরে যে অল্প কাজ বাকি আছে- সেখানে সিমেণ্টের ব্লক ফেলা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা কাজ শেষ করতে পারবেন।


প্রকল্পের ১ নম্বর লটের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ম্যানেজার গৌতম দাস মোবাইল ফোনে জানান, তাদেরও কাজ প্রায় শেষের দিকে। তাদের মাত্র ১২০ মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ বাকি রয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যে তারা সাইটে গিয়ে কাজ শুরু করবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।


টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রকল্প এলাকায় যমুনার ভাঙনে বিশালাকার পুকুর হওয়া স্থানে এবারই গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ বিষয়ে প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরি করে পাউবো কেন্দ্রীয় অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে।

পাউবো’র প্রধান প্রকেীশলী আব্দুল মতিন সরকার সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। ২-১ দিনের মধ্যে প্রকল্পটির অনুমোদন হবে এবং অতিদ্রুত কাজ শুরু করা হবে। যে কোন মূল্যে আগামি বর্ষার আগেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা হবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno