আজ- ১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ সোমবার  দুপুর ২:৩৫

যমুনার বালু দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে নিউ ধলেশ্বরীর গাইড বাঁধ!

 

বুলবুল মল্লিক:

বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর সোয়া কিলোমিটার দক্ষিণে যমুনা নদীর বাম তীরে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেকে) চারটি পৃথক লটে ২৩৪ কোটি ২৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকায় ১৫৩০মিটার গাইড বাঁধ(অফটেক বাঁধাই) নির্মাণ করা হচ্ছে যমুনা থেকে উত্তোলিত বালু দিয়ে।

ফলে বর্ষা মৌসুমে নির্মিতব্য ওই বাঁধ ধসে আশপাশের চারটি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছে যমুনা তীরবর্তী এলাকাবাসী।

সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার(নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর ভাটিতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেক) খনন কাজ চলছে। দুইটি বড় ড্রেজার দিয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বিভাগ দিনরাত খনন কাজ চালাচ্ছে।

ওই ড্রেজড বালু দিয়ে দক্ষিণে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের বেলটিয়া ও হাটবাড়ী আলিপুর অংশে চারটি ভাগে ১৫৩০মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে।

যমুনার গড় গভীরতা ৫.৯ রিডিউস লেবেল(আরএল) অনুযায়ী তীরের নিচের অংশে ঘুর্ণাবর্ত স্রোত নিয়ন্ত্রণে মাঝারি আকারের পাথর ও সিমেণ্টের তৈরি ব্লক ফেলা হচ্ছে। নদীতীরে ৩৩মিটার প্রস্থে বাঁধ নির্মাণ চলছে।

বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গড়িমসি ও ধীরগতির কারণে যথা সময়ে কাজ শেষ হবেনা বলে যমুনা ও নিউ ধলেশ্বরী নদীপাড়ের বাসিন্দারা আশঙ্কা করছে। আগামি বর্ষার আগে নির্মাণ কাজ অর্ধসমাপ্ত থাকলে যমুনা ও নিউ ধলেশ্বরী নদীতে ব্যাপক আকারে ভাঙন দেখা দিবে। এতে নির্মাণ কাজে ব্যয়িত অর্থ নদীর পেটে চলে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।

টাঙ্গাইল পাউবো সূত্রে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/২০১৭-১৮, লট নং-০১) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের বামতীরে বেলটিয়া অংশে ৪৫০মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে ঢাকাস্থ এসএস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৫৬ কোটি ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে বিগত ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর কাজ শুরু করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিনেও প্রতিষ্ঠানটি বেলটিয়ায় কাজ করেনি। চলতি অর্থবছর কাজ শুরু করলেও গত ২১ জানুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত তারিখে কাজ শেষ না হওয়ায় আগামি ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়েছে।

প্রকল্পের (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/২০১৭-১৮, লট নং-০২) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের বামতীরে বেলটিয়া অংশে ১৭৮মিটার টার্নিং সহ ৩২৮মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে ঢাকাস্থ এআরকেএল ও কিউএইচএমসিএল জয়েন্টভেঞ্চার(JV) কোম্পানী।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৬১ কোটি ১৯ লাখ ২২ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর কাজ শুরু করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিনেও সাইটে আসেনি।

গত ২৪ ডিসেম্বর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে বেলটিয়া অংশে কাজ শুরু করে। তাদেরকে কাগজে-কলমে আগামি ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য সময় বর্ধিত করা হলেও আগামি ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পাউবো’র প্রকল্পের (প্যাকেজ নং-(BRRP-CGB/২০-২১, লট নং-০৩) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের দক্ষিণে ডানতীরে হাটবাড়ী আলিপুর অংশে ৭৮.৫০মিটার এন্টারমিনেশন সহ ৩৭০মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে প্রাক্কলিত মূল্য ৫৬ কোটি ২৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়।

ঢাকার বিজয় নগরস্থ আকরাম টাওয়ারের এলএ-টিটিএসএল নামক দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জয়েন্টভেঞ্চারে(JV) ৫০ কোটি ৬২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা চুক্তিমূল্যে বাঁধ নির্মাণের কাজটি পায়।

গত বছরের ৯ডিসেম্বর কার্যাদেশ পেয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে। আগামি ৩০ জুনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রকল্পের (প্যাকেজ নং-BRRP-CGB/২০১৭-১৮, লট নং-০৪) নিউ ধলেশ্বরী নদীমুখের ডানতীরে হাটবাড়ী আলিপুর অংশে ৭৮.৫০মিটার টার্নিং ও ১২৫মিটার উইং সহ ৩৮২মিটার গাইড বাঁধ নির্মাণে কাজ করছে ঢাকাস্থ কেএসএ ও এলএ জয়েন্টভেঞ্চার(JV) কোম্পানী।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি ৬৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা চুক্তিমূল্যে ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ পাওয়ার পর ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর কাজ শুরু করার কথা থাকলেও দীর্ঘদিনেও সাইটে আসেনি।

চলতি অর্থবছরে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে(অফটেকে) হাটবাড়ী আলিপুর অংশে কাজ শুরু করে। তাদেরকে আগামি ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সরেজমিনে আলিপুর মসজিদ কমিটির সেক্রেটারী আব্দুল বাছেদ মাস্টার, একই এলাকার আলী আজম, মো. আনিছুর রহমান, হাটবাড়ী আলিপুরের আন্তাজ মন্ডল, আজগর আলী মন্ডল, আলিপুর বাজার সমিতির সভাপতি সুজাব আলী, বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান,

ভৈরববাড়ীর সরোয়ার হোসেন, আব্দুর রহমান, বেলটিয়ার জাহাঙ্গীর আলম, মজনু মিয়া, সোলায়মান হাসান, রফিকুল ইসলাম, শাহাদত হোসেন সহ অনেকেই আক্ষেপ করে জানান, পাউবো যমুনা নদীতে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখে ‘বালির বাঁধ’ নির্মাণ করছে। ‘বালির বাঁধ’ কখনও টেকসই হয় বলে তারা শুনেন নাই।

পাউবো ৩ নম্বর লটে ৩৭০মিটার বাঁধ নির্মাণে টেন্ডার করেছে অথচ আর মাত্র ২০০মিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হলে আলিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসা, মসজিদ, আলিপুর খাল ও বাজারটি রক্ষা পেত। তা না করায় উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলিপুর, ভৈরববাড়ী, বেলটিয়া ও হাটবাড়ী আলিপুর গ্রামের বসতবাড়ি ও ফসলী জমি আসন্ন বর্ষায় যমুনার পেটে চলে যাওয়ার প্রায় নিশ্চিত আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

একই সাথে বাঁধের পেছনে আলিপুর খাল দিয়ে যমুনার পানি ঢুকে পুরো উন্নয়ন কর্মকান্ডই যমুনা গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া নিউ ধলেশ্বরীর ভাটিতে ৪ নম্বর লটে ৩৮২মিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু ওই সীমানার বাইরে আলিপুর খালের মুখ রয়েছে। ওই মুখ ও আশপাশের এলাকায় বাঁধ দেওয়া না হলে ভাঙনের সম্ভাবনা রয়েছে।

তারা জানান, যমুনা নদীর তলদেশে মাঝারি আকারের পাথর ও স্ল্যাব ফেলে স্রোত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ৩৩মিটার প্রস্থের বাঁধ নির্মাণের শুরুতেই যমুনা থেকে উত্তোলিত বালু ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তার উপর স্ল্যাব দেওয়ার কথা রয়েছে। বালুর উপর স্ল্যাব কতটা স্থায়ী হবে তা নিয়েও তারা শঙ্কিত।

এছাড়া যমুনার তলদেশ থেকে তীরের উপরিভাগ পর্যন্ত মাত্র ৩৩মিটার উচ্চতার বাঁধ উঁপচে পানি গড়াবে বলে তারা ধারণা করছেন। বর্ষাকালে তীর উঁপচে পানি গড়ালে বাড়িঘর ও ফসলি জমি প্রমত্ত্বা যমুনার ভাঙনের শিকার হবে।

বাঁধ নির্মাণে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হাসমত আলী, গোপাল চন্দ্র সাহা, দিপক রায়, মো. শিহাব জানান, তারা কোম্পানীর নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করছেন। কাজ সম্পন্ন করতে প্রতিদিন ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তারা পরিশ্রম করছেন।

২ নম্বর লটের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. রাকিব হোসেন জানান, কার্যাদেশ পেয়ে তারা একটি সাব ঠিকাদারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন- এজন্য কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে।

তিনি জানান, পাউবো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন পেয়েও বিলের টাকা ছাড় করতে কালক্ষেপন করছে। সময় মত বিল পেলে আগামি বর্ষার আগেই তারা বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারবেন।

টাঙ্গাইল পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পাউবো প্রকল্প গ্রহন করেছে। বালু পিষে প্রক্রিয়াজাত করে বাঁধ দেওয়া হয়ে থাকে। সুতরাং এটাকে বালির বাঁধ বলা যাবেনা।

গাইড বাঁধ ও খনন কাজ সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। নিয়মানুযায়ী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে টাকা ছাড় করা হচ্ছে। চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে আসন্ন বর্ষার আগেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

পাউবো কেন্দ্রীয় অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী ও বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের পরিচালক(পিডি) আব্দুল মতিন সরকার বলেন, টাকা বড় কোন সমস্যা নয়, আমরা কাজের বিপরীতে টাকা ছাড় করে থাকি।

এগার বছর দীর্ঘ সময় হলেও নদী খনন করার পর আবার পলি পড়ায় পুনরায় খনন করতে হয়েছে। হাটবাড়ী আলিপুর অংশে ৩৭০মিটারের পর বাজার, মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাঙন ঠেকাতে আমরা গত বর্ষায় জিওব্যাগ ফেলেছিলাম।

এবারও সমস্যা বেশি হলে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই এলাকায় গাইড বাঁধ নির্মাণে একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছে, আগামি শুস্ক মৌসুমে কাজ করা হবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno