আজ- ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  দুপুর ১:৪৪

সখীপুরে ঐতিহ্যবাহী ফাইলা পাগলার মেলা চলছে :: ফাইলার ইতিকথা

 

দৃষ্টি নিউজ:


টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার পাহাড়িয়া অঞ্চল দাড়িয়াপুরে জমে ওঠেছে ঐতিহ্যবাহী ফাইলা পাগলের মেলা। প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের গমনাগমনে সরগরম হয়ে ওঠেছে মেলা প্রাঙ্গন। রোববার(৩১ ডিসেম্বর) থেকে সখিপুরে ফাইলা পাগলার মেলা শুরু হয়েছে।
মেলার আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার হোসেন মাস্টার জানান, বিগত ৬৪ বছর যাবত ফাইলা পাগলের মেলা চলছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ’ শ’ পাগল এখানে এসে মিলিত হন। তারা হযরত শাহ্‌ সূফী ফালু চাঁন(রহ.) ওরফে ফাইলা পাগলের নাম জপেন। হাজার হাজার ভক্ত-আশেকান ও সাধারন মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা বাসনার মানত নিয়ে মেলায় আসেন। তারা মানত নিজেরা রান্না করে নিজেরা ভক্ষণ করে থাকেন এবং পাগলের মাজারে দান-খয়রাত করে থাকেন। পাগলের নামে মানত করলে মনের বাসনা পুরন হয় বলে লোক সমাগম প্রতিবছর বাড়ছে। এ মেলার কথা কউকে জানাতে হয় না, কোন জাকেরও নাই। মানুষ আপন ইচ্ছায় এসে মানত খেয়ে চলে যায়।
তিনি আরও জানান প্রতি বছর এ মেলায় ৪-৫ লাখ টাকা দান-খয়রাত থেকে পাওয়া যায়। তিনি জানান, পাগলের মেলায় কোন অপকর্ম করলে প্রকৃতিগতভাবে শাস্তি পেতে হয়। বিগত ২০০৩ সালে বোমা হামলায় মেলার খাদেম সহ ৯ জন মারা যান। আর পাগলের মাজার অপবিত্র করার কারণে বোমা হামলাকারিদের দু’জন মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মেলা থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা আয় হলেও পাগলের মাজারের কোন উন্নয়ন করা হয় না। এ নিয়ে আয়োজক কমিটির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও অর্থ আত্নসাতের অভিযোগ পাওয়া যায়। সখীপুর উপজেলা সদর থেকে দুরে প্রত্যন্ত পাহাড়িয়া অঞ্চলে মেলাস্থল হওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোন নজরদারি করা হয়না। শুধুমাত্র থানা পুলিশের কিছু সদস্য দেয়া হয় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য। ফাইলা পাগলের মাজারের দু’কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেলা বসলেও মূল আয়োজন থাকে মাজার ঘিরে।
মাজারের পাশে পাগলরা দিনরাত সিদ্ধি পান করে মশগুল হয়ে জিকির করে থাকে। কিন্তু কোথাও কোন অপকর্ম সাধারনত ঘটে না। অন্যসব মেলার মতো এ মেলায় জুয়ার আসর বসেনা।
মেলায় বোমা হামলার পর ২-৩ বছর ফাইলা পাগলার মেলা জমে ওঠেনি। কয়েক বছর যাবৎ মেলা জমেনি।বর্তমানে আবার অসংখ্য ভক্ত, মানতকারী ও দর্শকদের আনাগোনায় পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে মেলা। অতীতকে ভুলে গিয়ে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী মানুষের আগমনে আবার জমে ওঠেছে ফাইলার মেলা।
এ বিষয়ে মেলা উৎযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার হোসেন মাস্টার আরো জানান, প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও মাসব্যাপী মেলা উৎযাপনের উদ্দ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে।দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাখো ভক্তরা যাতে নির্ভিঘেœ মেলা উদযাপন করতে পারে সেজন্য মেলা কমিটি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছেন। ভক্তরা যতদিন মেলায় অবস্থান করবেন মেলাও ততদিন চলবে। তবে মাঘি পূর্ণিমার দিন এবং আগে ও পরের দুই দিনই মেলায় ভক্তদের সমাগম বেশি হয়ে থাকে।                                                                                              খন্দকার ফালু চাঁনের ফাইলা পাগল হয়ে ওঠা:
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন সূত্রে জানা যায়, বাসাইল উপজেলায় কাশীল ইউনিয়নের দেউলী গ্রামে সম্ভ্রান্ত খন্দকার বংশে জন্ম এই ফাইলা পাগলার। শৈশব থেকেই ক্ষ্যাপাটে স্বভাব তার। তার নাম ছিল খন্দকার ফালু চাঁন, ডাক নাম ফাইলা। আর ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের জন্য ডাকত ফাইলা পাগলা বলে। পরবর্তীতে এ নামের আড়ালেই হারিয়ে যায় মূল নাম। গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। উচ্চতা ছিল প্রায় ৬ ফুটের কাছাকাছি। বেশীর ভাগ সময়েই থাকতো নেংটি পরা, শীতে- গ্রীস্মে একই অবস্থা। একটা ছেঁড়া কাঁথা তোলা থাকতো কাঁধে। বেশীর ভাগ সময় মেজাজ থাকতো তিরিক্ষি। ভাল থাকলে গৃহস্থালী কাজেও হাত লাগাতো । হাটে- মাঠে ঘুরে বেড়াত । উচ্চতা দেখে দুর থেকেই চেনা যেত পাগলাকে। শীত গ্রীস্ম সব সময়ই সে খেতো পান্তা ভাত। ভাত কমবেশী হোক সমস্যা নেই। গামলা ভর্তি পানি না হলে ক্ষেপে যেতো, এজন্য একবার বউ পিটিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল সে।
মাঝে মাঝে পাগলা বনে-বাদাড়ে লাকড়ি কুড়ায়। ছোট ছোট আঁটি বাঁধে। প্রতি আঁটির দাম ধরে চার আনা। তার বেশীও নয়, কমও নয়। চার আনাই দিতে হবে। লাকড়ি বিক্রির পয়সা দিয়ে কিনত চাল-ডাল-তেল নুন সহ নানাবিধ তরকারী। তারপর বিচিত্র পদ্ধতিতে রান্না। সব তরিতরকারি চাল ডাল এক হাঁড়িতে চাপিয়ে দিতো। তারপর তৃপ্তি সহকারে ভোজন। যেদিন রান্না করত সেদিন এই নিয়ম। অন্য সময় বাড়ী বাড়ী ভাত চেয়ে খেত। কতগুলো বিরক্তিকর অভ্যাস ছিল তার। কথায় কথায় মানুষের গায়ে থুকথুক ছিটাতো। ঘরের চালে, নৌকার ছৈয়ায়, নয়তো মাস্তুলের আগায় উঠে গান গাইতো সে। অকারণে মানুষকে মারতে যেত। আর অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ ছিল সার্বক্ষণিক অভ্যাস। শোনা যায় একাধিক বিয়ে করেছিল সে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিয়েটি টিকেনি। প্রথমটি ছিল করাতি পাড়ায় এবং দ্বিতীয়টি ছিল দাপনাজোড়ে। তবে কালিহাতীর তৃতীয় বিয়েটি টিকেছিল অনেকদিন। এই স্ত্রী ‘হইলা বেগম’ সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল পাগলা। তারপর বাড়ি ছেড়েছিল সে, আর ফিরেনি।
এক সময় তাকে দেখা যায় দাড়িয়াপুরের পাহাড়ে। এখানে সেখানে হাত পেতে দিন চলে। রাত কাটে গাছ তলায়। এ বাড়ি ও বাড়ির বারান্দায়। সখিপুর পাহাড়ের আদিবাসী জাতি মান্দীদের বাস। এক কৃপাশীল মান্দী আশ্রয় দেয় পাগলাকে। শুধু আশ্রয় নয়, পাগলের জন্য দয়ামায়াও উথলে উঠে তার। কিন্তু পাগল পাগলই। মাঝে মাঝে সে মান্দীর সাথেও দুর্ব্যবহার করে। মারপিট করতে যায়, গালি গালাজ করে, এটা সেটা ভেঙ্গে অনর্থের সৃষ্টি করে। মন ভাল থাকলে আবার বাড়ির কাজেও লাগে। একদিন পাগলের মন ভাল। মান্দীর জমিতে তখন বীজ বপনের সময়। প্রয়োজনীয় বীজ মেপে পাগলার কাঁধে চাপিয়ে দেয় ক্ষেতে ছিটানোর জন্য। পাঁচ বিঘা জমির মধ্যে সোয়াশের ধান ছিটিয়ে পাগলা বাড়ি চলে আসে। মান্দাই অবাক। পাগলকে জিজ্ঞাস করতেই ক্ষেপে যায় সে। মান্দীকে বলে দিল ঠিক ১০দিন পর ক্ষেত দেখতে যাবি। তার আগে গেলে ভূমিতে এক ফোটা ধানও হবে না। সরল হৃদয়ের মান্দাই দশ দিন পর গিয়ে দেখে সতেজ চারায় পরিপূর্ণ তার ধানক্ষেত। কোথাও ফাঁক নেই। সেবার তার ফসল ফলেছিল অন্যান্য বারের দ্বিগুণ। তারপর থেকেই মান্দাইয়ের ভক্তি বাড়ে পাগলের উপর। একবার এক গোখরো সাপ ছোবল মারে মান্দাইয়ের ছেলেকে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। ওঝা পাওয়া গেল না। খবর পেয়ে ছুটে আসে পাগলা। মুখের থুথু ঘষে দেয় দংশিত স্থানে। চোখ মেলে তাকায় মান্দীর ছেলে- সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ সে। লোকজন হতবাক। রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে এ সংবাদ। বিখ্যাত হয়ে উঠে ফাইলা পাগলা। ঝড়-ঝঞ্ঝার, বন্যা-খরা, দুর্ভিক্ষ মহামারির ভবিষ্যৎ বাণীও করত সে। অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেত তার কথা। যে পাগল ছিল সকলের অবহেলার পাত্র, এই সব অলৌকিক গুণে সকল অবহেলা শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে রূপ নেয়। সৃষ্টি হয় এক বিশাল ভক্ত বাহিনীর।
১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পাগলা মারা গেলে কবরস্থ করা নিয়ে শিষ্যদের মাঝে বাক-বিতন্ডার সৃষ্টি হয়। আত্মীয়রা চায়, পাগলার নিজ গ্রাম বাসাইলের দেউলীতে, আর ভক্তরা দাড়িয়াপুর পাহাড়ে সমাধিস্থ করতে চায়। শেষ পর্যন্ত ভক্তদের অনুরোধে দাড়িয়াপুরে তাকে সমাহিত করা হয়। পশ্চিমে গিলাবাড়ি গ্রাম। গ্রামের উত্তর পূর্ব প্রান্তে বংশাই নদী। নদী পার হয়ে লাল মাটি পেরিয়ে পূর্ব দিকে কিছুদূর অগ্রসর হলেই দাড়িয়াপুরের ফাইলা পাগলার মাজার পাওয়া যায়। মাজার ঘিরে তিন দিন ব্যাপী শুরু হয় জাকজমকপূর্ণ মেলা, হাজার হাজার ভক্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসে এই মেলায়। ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করে মাজারে। শ্রদ্ধাভরে তারা স্মরণ করে ফাইলা পাগলার কথা। লৌকিক এবং পরলৌকিক মঙ্গলের আশায় নিবেদন করে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno