আজ- ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বুধবার  সকাল ১০:৪২

আনারসের বাজার মন্দা- লোকসানে কৃষক

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইলের মধুপুর, ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলা রসালো ফল আনারসের জন্য প্রসিদ্ধ। মধুপুরকে আনারসের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। ভরা মৌসুমে বাজার মন্দা থাকায় লোকসানে পড়ে কৃষকরা আনারস চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পরিমিত কেমিকেল ব্যবহারে চাষিদের প্রশিক্ষণের তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় কেউ কেউ বিদেশি জাতের এমডি-২ আনারস চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠছে।


আগস্ট মাস চলছে- সাধারণত জুলাই-সেপ্টেম্বর আনারসের ভরা মৌসুম। আনারসের রাজধানী মধুপুর-ঘাটাইলে এ সময়ে আনারসকে ঘিরে কৃষক, পাইকার, মহাজন ও স্থানীয় পরিবহন শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার হাট-বাজারে আনারসের বেচাকেনা জমে উঠেছে। স্থানীয় চাষি ও পাইকারদের দম ফেলার ফুঁসরৎ নেই।

এতদাঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল আনারস প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যাচ্ছে। চাষিরা আশায় বুক বাঁধলেও এবার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। গত দশ বছরের মধ্যে এবার আনারসের বাজারে সবচেয়ে বেশি ধস নেমেছে। এ মন্দায় আনারস চাষিরা লোকসান গুনতে বাধ্য হচ্ছে। চাষিদের মুখে অতীতের সেই হাসি নেই। দাম কম থাকায় পাইকার ফড়িয়ারাও সুবিধা করতে পারছে না। উৎপাদন খরচ ঘরে তুলতে না পারায় অনেক চাষি আগামিতে আনারস চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।


মধুপুর কৃষি অফিস সূত্রে জানাগেছে, এ বছর মধুপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের আবাদ হয়েছে। এ এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ মেট্রিকটন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে- দুই লাখ ৭৩ হাজার ৬০০ মেট্রিকটন। গত বছরের চেয়ে এবার আনারসের চাষ বেশি হয়েছে। এতদাঞ্চলে ইতোপূর্বে জায়াণ্টকিউ বা ক্যালেন্ডার, হানিকুইন বা জলডুগী এ দুই জাতের আনারসের চাষ হতো। এবার থেকে বিশ^খ্যাত ফিলিপাইনের সুপার সুইট এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকার লাল মাটিতে জায়াণ্টকিউ বা ক্যালেন্ডার জাতের আনারস সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে।


এ সময়ে বাগান ও বাজারে আনারসের মৌ মৌ গন্ধ। এ মৌসুমেই এতদাঞ্চলের অর্র্থনীতির মুল চালিকাশক্তি। বাজার মন্দা থাকায় এবার লাভের অংক কৃষকের পকেটে আসছে না। লোকসানে হতাশায় দিন গুনছে কৃষক। ব্যাংক লোন, সারের দোকান বাকি ও শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।


সরেজমিনে মধুপুরের জলছত্র, মোটের বাজার, ইদিলপুর, পিরোজপুর, দোখলা, সানিয়ামারি ও আউশনারা; ঘাটাইল উপজেলার সাগরদীঘি, গারোবাজার, পাকুটিয়া এবং সখীপুর উপজেলার কচুয়া, বড় চওনা বাজারে গিয়ে কৃষক, পাইকার, ফড়িয়া ও মহাজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত বছরের চেয়ে এ বছর বাণিজ্যিক চাষ বেশি হওয়ায় আনারসের বাজার মন্দা।


বাণিজ্যিক চাষের ফলে অতি মুনাফালোভীদের থাবায় রসালো ফল আনারস ঐতিহ্য হারাচ্ছে। অপরিপক্ক গাছে অসময়ে আনারস বের করার জন্য বাণিজ্যিক চাষিরা অসাধু পন্থায় কেমিকেল প্রয়োগ করছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় চাষিরা নামে-বেনামে নানা কোম্পানির কেমিকেল দেদারছে ব্যবহার করছে। মাত্রাতিরিক্ত কেমিকেল প্রয়োগের ফলে গাছ ও ফলের রাতারাতি ফলনের অসম প্রতিযোগিতায় নেমেছে বাণিজ্যিক চাষিরা। বড় ফল উৎপাদন করে বাজার দখল করার মানসিকতার কারণে এতদাঞ্চলের আনারসের আদি আকার হারিয়ে যাচ্ছে।

রসালো ফলের স্বাদ ও গন্ধ এক প্রকার বিস্বাদে পরিণত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাটি উর্বরতা বিনষ্ট হচ্ছে। কেমিকেল ব্যবহারের ফলে বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আনারস বিক্রি করতে হচ্ছে- কেমিকেলের প্রতিক্রিয়ায় বাগানের আনারস বাগানেই পঁচে-গলে নষ্ট হচ্ছে।

ফলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। স্থানীয় পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি, বাড়তি শ্রমিক মজুরি, সার ও কেমিকেলের অতিরিক্ত খরচ, পাইকারদের মোকামে চাহিদা কম এবং মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম সহ নানা কারণে আনারসের চাহিদা ভোক্তা পর্যায়ে দিনদিন কমে যাওয়ায় এ বছর বাজার মন্দা যাচ্ছে- স্থানীয়রা এমনটাই ধারণা করছে। তবে প্রাকৃতিকভাবে(অর্গানিক) চাষ করা আনারসের খুচরা পর্যায়ে চাহিদা ও দাম অনেক বেশি।


মধুপুরের আনারস চাষি হাবিবুর রহমান জানান, প্রতিটি আনারসের চারা জমিতে আনা পর্যন্ত হাল-চাষ রোপণসহ ৮-৯ টাকা খরচ হয়েছে। এখন বাগান থেকে আনারস কাটতে শ্রমিক মজুরি প্রতিপিস ১ টাকা। ভ্যান ভাড়া ৫ টাকা। পরিচর্যা খরচ বাদে তার প্রতিটি আনারসে খরচ হয়েছে ১৪-১৫ টাকা। ১৮ মাস পরিচর্যার পর আনারস বিক্রির উপযোগী হয়েছে। এ সময় সার, নিড়ানি, পোকামাকড় দমনে রাসায়নিক, রোদে পোড়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য খড় দিয়ে ঢেকে দেওয়াসহ দেড় বছরে তার আরও খরচ হয়েছে প্রতি আনারসে ৭-৮ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিটি আনারসে গড় খরচ পড়েছে ১৮-২২ টাকা। বাজারে আনারস বিক্রি করে খরচ বাদে হাতে পাচ্ছেন গড়ে ১৪-১৭ টাকা।


মধুপুরের আদিবাসী আনারস চাষি লরেন্স রেমা, লটিন দালবত, প্রবীণ সাংমা, অজিত রুগা, প্রাণেশ নকরেক, প্রণয় সাংমা, আগষ্টিন রেমা; স্থানীয় আনারস চাষি মজিবর রহমান, আবুল কালাম, বেলায়েত হোসেন, চান মিয়া সহ অনেকই জানান, বাজারে মাত্রাতিরিক্ত কেমিকেলযুক্ত আনারস বেশি থাকায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

তাদের আনারসে অপ্রয়োজনীয় কেমিকেল না থাকায় আকারে ছোট ও দেখতে অনেকটা সবুজাভ হলুদ। এজন্য দেখতে পরিপক্ক, রসালো ও আকর্ষণীয় না হওয়ায় ক্রেতারা আকর্ষিত হয়না এবং বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে আনারস চাষের খরচ না উঠায় লোকসান গুনছেন। আগামিতে ভালো মানের আনারস চাষ করবেন কি-না তা ভেবে দেখবেন বলে মতামত জানান তারা।


ঘাটাইলের গারোবাজারের কৃষক আজাদুর রহমান জানান, তিনি গেল বছর যে আনারস ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করেছেন, চাহিদা কম থাকায় এ বছর পাইকাররা ৩০-৩৫ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে চাচ্ছে না।


কুষ্টিয়ার আড়ৎদার শাহজাহান আলী জানান, এবার আনারসের চাহিদা কম। অন্যান্য বছর সকালে ট্রাক থেকে আনারস আড়তে নামালে খদ্দের ভিড় জমাতো। এখন ভিড় ও দাম দুটোই কম। প্রতিপিস ৬০-৭০ টাকার টাকার আনারস বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা।


আনারস চাষি সোহেল রানা জানান, আনারস বড় ও পাকাতে বিভিন্ন কোম্পানির রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গ্রোথ হরমোন ব্যবহারে আনারসের আকার বড় হলেও ভেতরে ফাঁপা ও পানসে হয়ে যায়। অধিক লাভের জন্য বড় করার আশায় প্রশিক্ষণহীন কৃষকরা মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করার ফলে এমন অবস্থা হয়ে থাকে।


পাকানোর জন্য রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে কয়েক দিনের মধ্যে আনারস হলুদ রং হয়ে যায়। এক সাথে সব আনারসে পাকা রঙ ধারণ করলে সহজে বিক্রি করা যায়। কিন্তু রাসায়নিক না দেওয়া হলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অল্প সংখ্যক আনারস পাকে- ফলে একসাথে বিক্রি করা যায়না। কৃষকরা টাকাও ঘরে আনতে পারেনা।


আনারস চাষি আ. রশিদ ১৬ শতাংশ জমিতে প্রাকৃতিকভাবে(অর্গানিক পদ্ধতিতে) চাষ করে ছোট সাইজের আনারস প্রতিপিস ২৫-৩৫ টাকা দামে বাগান থেকেই বিক্রি করেছেন। বাগান থেকেই ক্রেতারা কাড়াকাড়ি করে নিয়েছে।


বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক ছানোয়ার হোসেন জানান. চাষিদের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি হলেই নিরাপদ আনারস চাষ করা সম্ভব। রাসায়নিক মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগে ফসলের তেমন ক্ষতি হয় না। কৃষকরা ইচ্ছেমাফিক রাসায়নিক প্রয়োগ ও অপপ্রচারে আনারসের বেশি ক্ষতি হচ্ছে। তিনি কৃষকদের প্রতি দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীল ভূমিকার আহ্বান জানান।


মধুপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে এমডি-২ জাতের আনারসের চারা কৃষি বিভাগ আমদানি করে। পরে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মধুপুরের কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ১০৭ জন কৃষককে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ চারা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১২০ জন কৃষককে ২ লাখ ৭০ হাজার চারা দেওয়া হয়।

মধুপুরের মাটি আনারস চাষের উপযোগী ও প্রতিবছর প্রচুর আনারস উৎপাদিত হয়। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে অনেক আনারস নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বিদেশের বাজার ধরার জন্য নতুন জাতের এমডি-২ আনারস চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই জাতের আনারস পাকার পর প্রাকৃতিকভাবেই এক মাস সংরক্ষণ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে যে চারা বিতরণ করা হয়েছিল- সে ফল এখন বাজারে আসতে শুরু করেছে।


সরেজমিনে কৃষকরা জানায়, নতুন জাতের এই আনারস নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক শঙ্কা ছিল। কিন্তু সেই শঙ্কা এখন আর নেই। মধুপুরের অনেকেই এই জাতের আনারস চাষের পরিকল্পনা করছেন।


আনারসের পাইকারি হাট গারোবাজারে গিয়ে দেখা যায়, এমডি-২ জাতের আনারস চাষিদের অনেকেই বাজারে এনেছেন। পাইকাররা কেটে খেয়ে স্বাদ পরীক্ষা করে আনারস কিনছেন।


মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল জানান, এ বছর মধুপুরে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এ এলাকায় প্রতি হেক্টর জমিতে আনারসের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৮-৪০ মেট্রিকটন। এ বছর গতবারের চেয়ে আনারসের আবাদ বেশি হয়েছে। মধুপুরে এ বছর বিশ^ বিখ্যাত ফিলিপাইনের সুপার সুইট এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হচ্ছে।

পাহাড়ি লাল মাটিতে জায়াণ্টকিউ বা ক্যালেন্ডার জাতের আনারস সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে। নিরাপদ আনারস চাষের উপর কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা ধরণের পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে।


টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার জানান, মধুপুর গড়ের আনারসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে চাষি, পাইকারসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে। ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার রোধে সকলকে সচেতন হতে হবে। এতে ঊৎপাদন খরচ কমে আসবে।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno