আজ- ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  সকাল ৮:৩৯

ভাষা সৈনিকদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণে আইন প্রণয়ন সময়ের দাবি

 

বুলবুল মল্লিক:

টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। তৃতীয় সংস্করণের রূপ

বাঙালি চেতনার মূলভিত্তি ‘মাতৃভাষা’ আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন বাঙালির সব অধিকার আদায়ের প্রেরণা। বিশ্বে মাতৃভাষার জন্য আত্মদানকারী একমাত্র জাতি বাঙালি।

এ ভাষার অধিকার আদায়ে বাঙালিকে আন্দোলন-সংগ্রামে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতার স্বাদ পায় বাঙালি।

২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির শুধু অহঙ্কার নয়- এক অমর কীর্তি। আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা বিশে^ ভাষা আদায়ের পথপ্রদর্শকও।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ‘বাংলা’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি জাতিকে গর্বিত করেছে, করেছে মহিমান্বিত।

মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের বীরত্বগাথা ইতিহাস যেমন রয়েছে- তেমনই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও টাঙ্গাইলের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। টাঙ্গাইলের অনেক বীর সন্তান ভাষা আন্দোলনে জাতীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

জাতীয় পর্যায়ে অগ্রভাগে থেকে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত শামসুল হক।

এছাড়া প্রাজ্ঞ রাজনীতিক আবদুল মান্নান (প্রয়াত), ড. মফিজ উদ্দিন আহমদ (প্রয়াত), ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম (প্রয়াত), বেগম ফজিলাতুন্নেছা (প্রয়াত), সোফিয়া খান (প্রয়াত), সাইয়্যিদ আতিকুল্লাহ (প্রয়াত) ও আব্দুস সালাম (প্রয়াত) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

তাদের অনেকেই আন্দোলন করতে গিয়ে জেল-জুলুম ভোগ করেছেন। ১৯৪৮-৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে টাঙ্গাইলেও দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

টাঙ্গাইল জেলায় ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ভাষা সৈনিক বদিউজ্জামান খান(প্রয়াত), সৈয়দ আবদুল মতিন(প্রয়াত), সৈয়দ নুরুল হুদা (প্রয়াত), শামসুর রহমান খান শাজাহান (প্রয়াত), মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল (প্রয়াত), আবু সাঈদ খান (প্রয়াত),

হাতেম আলী তালুকদার (প্রয়াত), রমিনুজ্জামান রইজ (প্রয়াত), নারায়ন চন্দ্র বিশ্বাস (প্রয়াত). ঋষিকেশ পোদ্দার (প্রয়াত), হাবিবুর রহমান(প্রয়াত), বুলবুল খান মাহবুব ও হাসিনা হক (জীবিত), নাজমি আরা রুবি (প্রয়াত), আলী আকবর খান খোকা (প্রয়াত), হেকমত আলী মিয়া (প্রয়াত), রোকেয়া রহমান (প্রয়াত) প্রমুখ।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে তৎকালীন রমেশ হলের কাছে (বর্তমানে সাধারণ গ্রন্থাগারের পশ্চিম পাশে) তারা টাঙ্গাইলে সর্বপ্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করেন।

ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সহ জেলার সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই শহীদ মিনার। বর্তমানে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি প্রথমটির তৃতীয় সংস্করণ।

টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সহ জেলার ১১টি উপজেলা সদরের শহীদ মিনারগুলো বিভিন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানেরও অন্যতম স্থানে পরিণত হয়ে উঠেছে।

বাঙালির ভাষা আন্দোলনে টাঙ্গাইলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও জেলার দুই হাজার ৫৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক হাজার ৬২২টিতে শহীদ মিনার নেই।

এরমধ্যে টাঙ্গাইল সদরের ১৮টি মাদ্রাসা ও ৮টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা, বাসাইল উপজেলার ১১টি মাদ্রাসা ও ২টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা, সখীপুরের ২৭টি মাদ্রাসা ও ১৮টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা, দেলদুয়ারের ৯টি মাদ্রাসা ও ১টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা,

নাগরপুরের ১৩টি মাদ্রাসা ও ১৮টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা এবং ভূঞাপুর উপজেলার ২২টি মাদ্রাসা ও ১৫টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসায় কোন শহীদ মিনার নেই।

ফলে শিশু-কিশোরদের মাঝে দেশপ্রেম ও বাঙালির চেতনাবোধ গড়ে উঠতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে ভাষা সৈনিক ও বীরমুক্তিযোদ্ধা বুলবুল খান মাহবুব মন্তব্য করেছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার মোট এক হাজার ৬২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে এক হাজার ৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই।

এরমধ্যে ঘাটাইলের ১৭২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৪২টিতে, গোপালপুরে ১৬১টির মধ্যে ১৪৮টিতে, বাসাইলে ৭৯টির মধ্যে ৬৮টিতে, টাঙ্গাইল সদরের ১৬৩টির মধ্যে ১৩৪টিতে, দেলদুয়ারের ১০০টির মধ্যে ৭০টিতে, মির্জাপুরের ১৭০টির মধ্যে ১০১টিতে,

কালিহাতীর ১৭০টির মধ্যে ১২৭টিতে, মধুপুরের ১১০টির মধ্যে ৩৩টিতে, নাগরপুরের ১৫৬টির মধ্যে ১২৯টিতে, ভূঞাপুরে ১১০টির মধ্যে ৮৩টিতে এবং ধনবাড়ীর ৮৫টির মধ্যে ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই।

এরমধ্যে ব্যতিক্রম সখীপুর উপজেলার ১৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব কটিতেই শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ বলেন, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্যে সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকে না। তবুও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় উদ্যোগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা জেলায ১৬১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার।

যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীন মিনার নেই সেখানে দ্রুত শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

অন্যদিকে, জেলা শিক্ষা অফিসের অধীনে ৯৩৮টি উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, কারিগরি, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী ও মাদ্রাসা রয়েছে। এরমধ্যে ৫৫৩টি প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই।

কার্যালয় সূত্রে প্রকাশ, টাঙ্গাইল সদরের ১০৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৭টিতে, বাসাইলের ৪২টির মধ্যে ২৭টিতে, কালিহাতীর ৮৭ টির মধ্যে ৩৫টিতে, সখীপুরের ১০১টির মধ্যে ৭৪টিতে, ঘাটাইলের ১১৫টির মধ্যে ৭৭টিতে, গোপালপুরের ৮৪টির মধ্যে ৪১টিতে,

মধুপুরের ৭৭টির মধ্যে ৪৫টিতে, ধনবাড়ীর ৩৩টির মধ্যে ৩১টিতে, মির্জাপুরের ৭৬টির মধ্যে ২৬টিতে, দেলদুয়ারের ৩৮টির মধ্যে ১৫টিতে, নাগরপুরের ৭৭টির মধ্যে ৪৪টিতে ও ভূঞাপুরের ৭১ টির মধ্যে ৪৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই।

জেলা শিক্ষা অফিসার লায়লা খানম জানান, শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় জীবনের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার নির্মাণ করা প্রয়োজন।

বাঙালি চেতনাবোধে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে শহীদ মিনার অপরিসীম ভূমিকা রাখে। ইতোমধ্যে জেলার ৩৮৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।

অন্যগুলোতেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসাগুলোতে এক সময় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনকে ভিন্ন ব্যাখ্যা করা হত। এখন সময় পাল্টেছে- মাদ্রাসাগুলোতেও শহীদ মিনার নির্মাণ করা হচ্ছে এবং জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি জাতীয় দিবসগুলোতে অনুষ্ঠানাদি উদযাপন করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইলে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, রাজনীতিক, মহান মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর অন্যতম সংগঠক বয়োবৃদ্ধ বুলবুল খান মাহবুব আবেগে আপ্লুত হয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রায় পৌনে একশ’ বছর পরও ভাষা সৈনিকদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি করতে হয়- এটা শুধু ক্ষোভের নয়, লজ্জারও।

ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষা এবং শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, ভাষা সৈনিকদের সম্মানে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যে প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকবেনা তাদের সরকারি অংশের আর্থিক সহায়তা সহ কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জাতির ভাষা আন্দোলনের মূল প্রেরণা সম্পর্কে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির ২০জনের মধ্যে ১০জনই নারী সৈনিক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের কাউকে কাউকে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হলেও অনেকেই এর বাইরে রয়েছেন, কেউ কেউ আজও অবহেলিত।

তাছাড়া এখনও কোন নারী ভাষা সৈনিককে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়নি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকরণে ভাষা সৈনিকদেরও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান।

টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(শিক্ষা ও আইসিটি) সৈয়দ মাহমুদ হাসান জানান, ভাষা আন্দোলন বাঙালির ঐতিহ্য ও প্রেরণার ধারক-বাহক। মাতৃভাষার সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকা উচিত।

জেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে সরকারিভাবে বরাদ্দ না থাকলেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ নিজস্ব উদ্যোগেও শহীদ মিনার নির্মাণ করতে পারে।

প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিত্তবানরা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno