আজ- ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  দুপুর ১:৪৫

ভূঞাপুরে বালু উত্তোলন নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে ॥ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা

 

দৃষ্টি নিউজ:


টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও সরবরাহকে কেন্দ্র করে নানামুখী দ্বন্দ্বে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোন সময় রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। দীর্ঘদিন যাবত অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবিও করেছে এলাকাবাসী।
জানাগেছে, বঙ্গবন্ধুসেতুর উত্তরে ভূঞাপুর উপজেলার চরপাথাইলকান্দি থেকে গোবিন্দাসী পর্যন্ত ২০টি আলাদা ঘাট থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে গত দুই মাস যাবত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই বালুঘাটগুলোর ভাগবাটোয়ারা ও হিস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। এতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে একদিকে দেশের বৃহত্তর স্থাপনা বঙ্গবন্ধুসেতু হুমকির মুখে পড়ছে। অন্যদিকে যে কোন সময় স্থানীয় পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, নিকরাইল ইউপি চেয়ারম্যান মতিন সরকার ও আ’লীগ নেতা দুলাল চকদার বেপরোয়া হয়ে ২০টি বালুঘাট নিয়ন্ত্রণ করতে একটি সিন্ডিকেট গঠন করেন। ওই সিন্ডিকেট গঠন করার সময় ভাগ-বাটোয়ারা ও হিস্যা ঠিক মতো বণ্টন করা হলেও বর্তমানে তা হচ্ছেনা। ইউপি চেয়ারম্যান মতিন সরকার ও দুলাল চকদারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠেছে অন্য হিস্যাদাররা। ফলে জমির মালিক ও বালু ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। নদী তীরবর্তী ওই এলাকার জমির মালিকরা(লাল কার্ডধারী) বালু ব্যবসায়ীদের একেক গ্রুপের সাথে একেক সময় হাত মেলানোর কারণে ও অবৈধ বালু ব্যবসার হিস্যা নিয়ে তৈরি হওয়া মতবিরোধ দ্বন্দ্বে রূপ নিয়ে বর্তমানে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতির পর এরআগেও বালুঘাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় কয়েকজন বালু ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে জানান, মতিন সরকার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তার চাচাত ভাই নিকরাইল ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও আ’লীগ নেতা মোতালেব সরকারের বালুঘাট লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে দখল করে নেন। এরপর থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। মোতালেব সরকারের বালুঘাটে দেয় জমির মালিকরা সুবিধা না পেয়ে বাধ্য হয়ে মতিন সরকারের কাছে পুনরায় জমি লিজ দিয়েছে। ফলে মতিন সরকার, মোতালেব সরকার ও জমির মালিকদের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছে। তারা আরো জানায়, স্থানীয় প্রশাসনের সুপারিশে বিবিএ কন্ট্রাক্ট-৭ এর ডাবগুলো স্বল্প মেয়াদী বন্দোবস্ত দেওয়া বন্ধ করেছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসন ও জেলা-উপজেলার রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেই বালু ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। এতে ডাব লিজ দেওয়া বন্ধ থাকায় সরকার রাজস্ব পাচ্ছেনা অথচ স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা নগদ টাকা হাতাচ্ছেন।
অপরদিকে, বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ের কণ্ট্রাক্ট-৭ এর ২৪ ও ২৫ নং পুকুরের মধ্যবর্তী পাড়(ডাব/ ট্রাক চলাচলের রাস্তা) ব্যবহারের জন্য বিবিএ’র নির্বাহী পরিচালকের কাছে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল ‘লাল কার্ডধারী’দের পক্ষে মো. তোতা মিয়া আবেদন করেন। ওই আবেদনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন এমপি সুপারিশ করেন। একই আবেদনটি বিশেষ বিবেচনার জন্য স্থানীয় সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামান একই সালের ৩১ মার্চ একটি ডিও লেটার(চাহিদাপত্র বা আধা সরকারি পত্র) প্রদান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্বপাড়ের ডাব বা ট্রাক চলাচলের রাস্তা ব্যবহার বন্ধে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিপত্র জারি থাকায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ(বিবিএ) বিষয়টি বিবেচনার জন্য রাখে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী আ’লীগ নেতা দুলাল চকদার ও মতিন সরকার ওই ডাবটি দখলে নিতে তৎপর হয়। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়ও হয়। সংঘর্ষে দু’পক্ষের ১০-১২জন আহত হয়। পরে মতিন সরকার ও দুলাল চকদারের মধ্যে সমঝোতা হয় এবং ডাবটি(ট্রাক চলাচলের রাস্তা) দুলাল চকদার অবৈধভাবে ব্যবহার করতে থাকে। বর্তমানে অবৈধভাবে ডাবটি স্থানীয় নজরুল মেম্বারের নামে দুলাল চকদার ব্যবহার করায় জমির মালিক (লাল কার্ডধারী) মো. তোতা মিয়া, মো. আব্দুল মাজেদ, মো. আমজাদ আলী, এরশাদ আলী, ইসমাইল হোসেনদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। জমির মালিকদের মধ্যে মো. আমজাদ আলী প্রভাবশালী আ’লীগ নেতা দুলাল চকদারের পক্ষ নেওয়ায় ওই বিরোধ চরম আকার ধারন করেছে। যে কোন সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নিকরাইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোতালেব হোসেন সরকার জানান, বিবিএ কর্তৃক জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্তরাই লাল কার্ডধারী। এখন তারা নিজের ঘরেই পরবাসী হয়ে গেছে। মতিন সরকার ও দুলাল চকদারের আগ্রাসী থাবায় তারা বালু মহালের কোন সুবিধাই পাচ্ছেন না। মতিন সরকার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সর্বেসর্বা বনে গেছেন। উপর মহলকে ম্যানেজ করে বঙ্গবন্ধুসেতুর উত্তরে পাথাইলকান্দি থেকে গোবিন্দাসী পর্যন্ত ২০ বালুঘাটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তার বালুঘাট জবরধস্তি দখল করে নিয়েছে, রক্তপাতের আশঙ্কায় সে সময় তিনি কোন প্রতিবাদ করতে পারেন নি।
জমির মালিক মো. তোতা মিয়া জানান, তারা বৈধভাবে ডাব(ট্রাক চলাচলের রাস্তা) লিজ নেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করেছেন। অথচ দুলাল চকদার-মতিন সরকার গংরা গায়ের জোরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। উপজেলা, জেলা ও বিবিএ কর্তৃপক্ষকে জানালেও তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। উপরন্তু তারা(লাল কার্ডধারীরা) অবৈধ বালু ব্যবসায়ী কর্তৃক মামলা-হামলার শিকার হচ্ছেন।
নিকরাইল ইউপি চেয়ারম্যান ও বালু ব্যবসায়ী মতিন সরকার জানান, তারা সিরাজগঞ্জ ঘাট থেকে বালু কিনে ভূঞাপুরে আনলোডের পর বিক্রি করেন। যমুনা নদীর ভূঞাপুর অংশ থেকে বালু উত্তোলন করেন না। বালু ব্যবসায় অনেক টাকা পুজি বিনিয়োগ করতে হয়। যারা পুঁজি বিনিয়োগ করতে না পেরে অংশিদার হতে পারেনা তারাই বিরোধিতা করে থাকে। তারা কয়েকজন বালু ব্যবসায়ী একত্র হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন- এখানে দ্বন্দের কিছু নাই।
ভূঞাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম কাওছার চৌধুরী জানান, যেহেতু বিবিএ তাদের ডাব(ট্রাক চলাচলের রাস্তা) বন্দোবস্ত দেওয়া বন্ধ রেখেছে সেহেতু বালু সরবরাহের কোন সুযোগ নেই। তারপরও ব্যসায়ীরা বালু সরবরাহ করতে ওই ডাব ব্যবহার করছে- এটা অবৈধ।
বিবিএ’র বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব সাইট অফিসের সহকারী প্রকৌশলী ওয়াসিম আলী জানান, সেতুর উত্তরে ভূঞাপুর উপজেলার পাথাইলকান্দি থেকে গোবিন্দাসী পর্যন্ত বিবিএ’র মালিকানাধীন ডাবগুলো বন্দোবস্তের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। ওই ডাবগুলো দিয়ে বালুবাহী বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ। টাকা নিয়ে ডাবগুলো দিয়ে ট্রাক চলাচলের সুযোগ দেওয়ার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত। বালু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে ডাবগুলো ব্যবহার করছে।
ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম জানান, যমুনা নদীর ভূঞাপুর অংশ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করলে তার প্রভাব সরাসরি বঙ্গবন্ধুসেতুর উপর পড়বে- এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া বালুঘাটের নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষ নতুন কিছুনা। কিছুদিন পর পর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে হয়েই থাকে। বালু উত্তোলনকারীরা খুবই ধূর্ত। কিছু বালু সিরাজগঞ্জ বালুঘাট থেকে কিনে আনে, ওই বালু আনলোড করার সময়ই যমুনায় ড্রেজার বসায়। ড্রেজার উচ্ছ্বেদে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালানো হয়।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, টাঙ্গাইলে সব ধরণের বালুঘাট ইজারা বন্ধ রাখা হয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কোন সুযোগ নাই। বাল ব্যবসার সাথে রাঘব-বোয়ালরা জড়িত থাকার কারণে অনেক সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সমস্যা হয়- তবে প্রশাসনের উদ্যোগে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে। ভূঞাপুরের কয়েকজন ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জের ঘাট থেকে বালু কিনে ব্যবসা করছেন বলে তিনি শুনেছেন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno