আজ- ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বৃহস্পতিবার  বিকাল ৪:৪০

মহানায়কের জন্মদিন আজ

 

দৃষ্টি ডেস্ক:

পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে হাজার বছরের বাঙালিকে যিনি এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা, বিশ্বের বুকে যিনি এঁকেছেন বাংলার মানচিত্র, এনে দিয়েছেন গর্বিত পরিচয়- সেই রাষ্ট্রীয় মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মদিন আজ। আকাশ-বাতাসে তাই বইছে আনন্দের হিল্লোল; খুশির জোয়ারে ভাসছে গোটা দেশ।

বাঙালির মানসপটে ভেসে উঠেছে আজ সেই ছোট্ট ‘খোকা’র হাসিমাখা মুখচ্ছবি। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের প্রতিটি ঢেউই যেন এঁকে চলেছে তারই প্রতিকৃতি। প্রতি বছরের মতো এবারও এ দিনটি ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবেও উদযাপিত হবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।


হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন এখন ব্যাপক উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করা হলেও আত্মত্যাগী এই দেশপ্রেমিক তার জীবদ্দশায় সামান্য ঘটা করে নিজের জন্মদিন উদযাপন করতে পারেননি বহুবার। কেননা তার জীবনের আনন্দঘন এ দিনটি কখনো কেটেছে কঠিন সংকটে আবার কখনো অন্ধকার জেলখানায়।


১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারের রোজনামচায় লিখেছিলেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই। বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটা উপহার দিত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম।’


ওই জন্মদিনে সহবন্দিরা তাকে ফুল দিয়েছিলেন, কারাগারে কেক নিয়ে গিয়েছিলেন বেগম মুজিব আর তাদের ছেলেমেয়েরা। ছোট্ট রাসেল তার বাবাকে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। ঢাকায় আর চট্টগ্রামে শেখ মুজিবের জন্মদিন উদযাপিতও হয়েছিল। অথচ আজ এ মহানায়কের জন্মদিন উদযাপিত হবে বিশ্বের ১৯৫টি দেশে। বহির্বিশ্বে নানা অনুষ্ঠানমালা আয়োজনের পাশাপাশি ঢাকার আয়োজনে যোগ দিতে প্রস্তুতি নিয়েছেন বিশ্বনেতারাও।


আজ সকালে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। কর্মসূচি অনুযায়ী সমাধি সৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর রাষ্ট্রপতি কিছুক্ষণ সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হবে। বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে একটি চৌকস দল ‘রাষ্ট্রীয় সম্মান’ প্রদান করবেন।


রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে ফাতেহা ও দোয়া পাঠ করবেন। রাষ্ট্রপতি সমাধি সৌধ প্রাঙ্গণে রক্ষিত দর্শনার্থী বইতেও স্বাক্ষর করবেন। পরে বিকালে বঙ্গভবনের দরবার হলে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। দেশের অব্যাহত শান্তি ও সমৃদ্ধি, জনগণের কল্যাণ এবং মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য কামনা করে ও দোয়া করা হবে। মিলাদ-মাহফিল ও মোনাজাতে রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্য, সংশ্লিষ্ট সচিব, বঙ্গভবনের বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশ নেবেন।


বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল টুঙ্গিপাড়া গ্রামেই কাটে। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনার সময় তিনি চোখের দুরারোগ্য বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় তার চোখের অপারেশন করা হয়। এ সময় কয়েক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে।


স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কৈশোরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন। ম্যাট্রিক পাসের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। ওই সময় থেকে নিজেকে ছাত্র-যুব নেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন।


বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনসহ পাকিস্তানি সামরিক শাসনবিরোধী সব আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের এসব আন্দোলনের কারণে বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়।


১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাকে। আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন তথা বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন তিনি।


পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে তাদের কারাগারে পাঠান। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালি শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে ‘বঙ্গবন্ধু’র মর্যাদায় অভিসিক্ত করে।


১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে আওয়ামী লীগ; কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ বিজয়কে মেনে নেয়নি। এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলন এবং চূড়ান্ত পর্বে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দেন।


এ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মার্চে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ভাষণে সেদিন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দেন তিনি।


একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান এবং ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বীর বাঙালি একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।


১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। সদ্যস্বাধীন দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে নিজ বাসভবনে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন তিনি।


ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে হরতাল করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন বাংলার মানুষের মুক্তির প্রশ্নে। কতবার জেলে গেছেন! গোয়েন্দারা মুচলেকার বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করত তাকে। তিনি বলতেন, মৃত্যুবরণ করব, তবু বাংলার মানুষের মুক্তির প্রশ্নে আপস করব না কখনো।


বারবার নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আপস করেননি কোনোদিনই। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তার ফাঁসি হতে পারত। তাকে গুলি করে মারার ষড়যন্ত্রও হয়েছিল। একাত্তর সালে পাকিস্তানের কারাগারে তার সেলের পাশে তার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। তবুও মৃত্যুকে ভয় পাননি তিনি। বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ।’
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্ত স্বদেশে ফিরে এসে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’


তার জীবনের একটাই ছিল সাধ, একটাই ছিল স্বপ্ন, একটাই ছিল লক্ষ্য- স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি বলেছিলেন, তার বড় গুণ হলো দেশের মানুষকে তিনি বেশি ভালোবাসেন। তার দুর্বলতাও ছিল, দেশের মানুষকে তিনি একটু বেশি-ই ভালোবাসেন। রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ শেষ করে তিনি বলেছিলেন, ‘মনে আছে, আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব!’

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno