আজ- ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  সকাল ৮:৪৪

রসুলপুরে ঐতিহ্যবাহী ‘জামাইমেলা’ অনুষ্ঠিত

 

দৃষ্টি নিউজ:


টাঙ্গাইলের রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ‘জামাইমেলা’ শুক্রবার(২৭ এপ্রিল) সম্পন্ন হয়েছে। আনুষ্ঠানিক মেলা শেষ হলেও বিকিকিনি চলবে আরো ৪-৫দিন।
জানাগেছে, প্রতিবছর ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ (সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে) টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘জামাই’ মেলার আয়োজন করা হয়। তিন দিনে রসুলপুরসহ আশপাশের অন্তত ৩০টি গ্রামের লাখো মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়।
রসুলপুরের বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক রাশেদ রহমান, গালা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ফজলু সহ স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, এ মেলার উৎপত্তি কবে সেটা কেউ জানে না। যুগ যুগ ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ এলাকার প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষের কাছে ঈদ আর পূজা-পার্বনের চেয়েও এ মেলা বেশি উৎসবের। মেলাটি বৈশাখী মেলা হিসেবে ব্রিটিশ আমলে শুরু হলেও এখন এটি ‘জামাইমেলা’ হিসেবে অধিক পরিচিত।
বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে, মেলাকে সামনে রেখে রসুলপুর ও এর আশেপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাদের বরকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। মেলায় যাওয়ার আগে শ্বাশুরিরা মেয়ের জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা গুজে দেন। আর সেই টাকার সাথে আরও টাকা যোগ করে এলাকার জামাইরা মেলা থেকে মাটির তৈরি বড় কলসি ভরে চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, আকড়ি, চিনির তৈরি নানা জীব-জন্তুর আকৃতির মিষ্টান্ন(চিনি সাজ), মিষ্টি, জিলাপী সহ নানা জিনিস কিনেন। ঘর সাজানোর নানা তৈজসপত্রও কেনেন মেয়েরা। জামাইয়ের কেনা সেই মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যাদি আশেপাশের বাড়িতে বিলি করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা জামাইরা এতে অভিভূত হয়।
মেলায় ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নানা বিনোদন ব্যবস্থার আয়োজন করা হয়। শুধু তাই নয়, ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় ব্যবসা করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন। খুব বেশি লাভের মুখ নানা দেখলেও গ্রাম বাংলার অতীত ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে আসেন তারা। বাপ-দাদার গ্রামীণ ঐহিত্য ধরে রাখতে পেরে খুশী মেলার আয়োজকরা। পূর্বে এ মেলা সপ্তাহব্যাপী হলেও বর্তমানে বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ৭দিনের মেলাকে তিন দিনে নিয়ে আসা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এ মেলা শুরু হলে রসুলপুর ও এর আশেপাশের এলাকার মানুষের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়। টাঙ্গাইলের গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য মেলায় কিশোরী-যুবতী-নারীদের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ চোখে না পড়লেও রসুলুপরের জামাই মেলায় নারী-পুরুষ সবাই আসেন-কেনেন পছন্দের পণ্য। আর তাই দিন দিন এ মেলা হয়ে উঠছে আরও বৈচিত্রময়।
সরেজমিনে সকালে মেলা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন দোকানীরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছেন, আর ক্রেতারা তা কিনছেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এ মেলা বেশি উপভোগ করছে। এছাড়া মেলায় মিষ্টি জাতীয় দোকানের সংখ্যা বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ ইদ্রিস আলী বলেন, জন্মের পর থেকেই আমি এ মেলা দেখছি। আগে এ মেলাকে বৈশাখী মেলা বলা হতো, এলাকার জামাইদের মেলায় উপস্থিতি বাধ্যতামূলক(এলাকার রেওয়াজ অনুযায়ী) হওয়ায় এখন এটি জামাই মেলা হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, আমর একটি মেয়ে রয়েছে, তাকে বিয়ে দিয়েছি। মেয়ের জামাইকে আমি দাওয়াত দিয়েছি। তিনিও মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে এসেছেন।
অপর বাসিন্দা আসক আলী ও লুৎফর রহমান বলেন, এক মাস থেকে এই মেলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। লোকজন ছুটি নিয়ে মেলা দেখার জন্য আসেন। আগে বয়স্ক লোকজন এই মেলা উপভোগ করতো। এখন মধ্যবয়স্ক এবং ছাত্র-ছাত্রীরা এই মেলা বেশি উপভোগ করেন।
জামাল হোসেন নামে রসুলপুরের এক জামাই বলেন, আমি স্বাধীনতার আগে বিয়ে করেছি। প্রতি বছরই আসি মেলায়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকতে তারা আগে থেকেই দাওয়াত দিতেন। এখন তারা বেঁচে নেই। শ্যালক-শ্যালকের বউ এখন দাওয়াত দেয়।
নাসির উদ্দির নামে অপর এক জামাই বলেন, আমি প্রতিবছরই এ মেলায় আসি। মেলায় এসে আমার খুব ভালো লাগে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাদেরকে দাওয়াত দেন। তখন আমরা আসি। তিনি আরো বলেন, দাওয়াত পেয়ে কোন জামাই মেলায় না এলে তাকে এলাকায় অবাঞ্ছিত করা হয়।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থেকে আসা আকড়ি ব্যবসায়ী ছাদের আলী বলেন, আমি এ মেলায় ১০ বছর ধরে আসছি। এখানে বিক্রি করে আমি লাভবান হই। এ মেলাটি জামাই মেলা হিসেবে পরিচিত।
জামালপুর থেকে আসা আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী জানান, বিগত বছরগুলোতে রসুলপুরের জামাই মেলায় বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন।
মিষ্টি ব্যবসায়ী বাদল ঘোষ বলেন, এই মেলায় সব চেয়ে বেশি বিক্রি হয় মিষ্টি। সেজন্যই মেলায় মিষ্টির দোকান সবচেয়ে বেশি। মেলায় আসতে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি। মেলার কমিটির লোকজন থাকা-খাওয়া ও দোকান করা সহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন।
মেলার আহ্বায়ক আতোয়ার রহমান জানান, এ মেলা টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী একটি মেলা। আনুষ্ঠানিক মেলা শুক্রবার(২৭ এপ্রিল) শেষ হলেও দোকানীরা আরো ৪-৫দিন থাকবে, লোক সমাগমও হবে। এ মেলায় ছোট বড় মিলিয়ে কয়েক শ’ দোকান বসে। এখানে প্রায় শতাধিক লোক স্বেচ্ছায় মেলায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন। তিন দিনের মেলা হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত দোকানীরা আছেন ততক্ষণ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করবেন। মেলায় শুরু হওয়ার আগেই গ্রামের জামাই এবং মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা আসেন। এছাড়া প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক মেলা উপভোগ করেন।

 

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno