আজ- ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ রবিবার  সকাল ১০:৪৩

অসময়ে চলে গেলেন প্রফেসর লুৎফর রহমান

 

*আনোয়ার হোসেন বকুল*

তেরো অক্টোবর চলে গেলেন লুৎফর প্রফেসর। এলাকার মানুষের কাছে তিনি এ নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে মা আমেনা বেগম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। একই দিন মা-ছেলের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরিণত বয়সের আগেই লুৎফর রহমানের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না অনেকেই। এলাকার সব মানুষের সঙ্গে আমার শোক ও অশ্রু মিশে একাকার হয়ে গেছে। মানুষ তাঁকে আপনজন হিসেবে জানত। সকলের সাথেই তাঁর সম্পর্ক ছিল মধুর। সকলের এ প্রিয় মানুষটি বড়ো অসময়ে চলে গেলেন। শুনেছি গুণি মানুষর কীর্তির বহমানতা রয়ে যায়। তাঁরা অমলিন ভাবে বিরাজ করেন। বেঁচে থাকেন মানুষের মাঝে।

লুৎফর ভাইর মৃত্যুর সংবাদ শুনি ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ডে জনতা কম্পিউটারে বসে সাংবাদিক আতোয়ার রহমান মিন্টু ভাইর কাছ থেকে। সংবাদটা আমাকে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসিয়ে রেখেছিল- কিংকর্তব্য বিমুঢ়। আবেগ ও শোকে হৃদয়ের গভীরে কী এক অজানা ত্রিশূল যেন বিধেঁছিল। মিন্টু ভাইকে সাথে নিয়ে ছুটে যাই লুৎফর ভাইর ভূঞাপুরের বাসায়। শোকাহত মানুষের ভীর ঠেলে গিয়ে দেখি লুৎফর ভাই শেষ ঘুম ঘুমোচ্ছেন। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়াতেই আমার জীবন-মৃত্যু সর্ম্পকিত ভাবনাগুলো সচল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে বিখ্যাত সেই লালন সংগীত- ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়/ ধরতে পারলে মনোবেরী দিতাম পাখির পায়’। এসময় আমার দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। জীবন-মৃত্যুর ভাবনা আমরা নিত্যদিন ভাবিনা, বলা যায় ভাবতে পারিনা। কোন্ দিন- কোন্ সময় আমার জীবন খাঁচার পাখি উড়াল দিয়ে চলে যাবে তা কি আমি জানি ?

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ডাকিয়াপটল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন লুৎফর রহমান। তাঁর পিতার নাম জসিম উদ্দিন। মাতা আমেনা বেগম। লুৎফর রহমান ছাত্র জীবনে তুখোর ছাত্রনেতা ছিলেন। টাঙ্গাইলের বিশেষ করে উত্তর টাঙ্গাইলে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে পরীক্ষিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্কুলের চৌকাঠ না পেরোতেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তীতে ছাত্র জীবনের পুরোটা জুড়ে ছিল ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগ রাজনীতির চর্চা। সে সময় কালিহাতী উপজেলার নারান্দিয়া, ঘাটাইল উপজেলার আনেহলা ও লোকেরপাড়া ইউনিয়ন নিয়ে ছাত্রলীগের আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়। তিনি ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি আনেহলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। সারা জীবন তিনি সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে লড়ে গেছেন। গত ১১ অক্টোবর ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংএ অংশ গ্রহণ ছিল তাঁর জীবদ্দশায় সর্বশেষ মিটিং।

কর্ম জীবনে ফলদা শিহাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। শিক্ষার মানোন্নয়নে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনে তাঁর ছিল সরব উপস্থিতি। প্রবল আত্মবিশ^াসী লুৎফর রহমান নিজেকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। লোকেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকরাম হোসেন খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সম্পর্কে লুৎফর ভাইর উকিল শশুর আকরাম খান। জামাই-শশুর মিলে আব্দুল্লাহ আল হাকাম ভুট্টো ও বোরহান তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগীতায় লোকেরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

শোক বিঁধুর পরিবেশেও আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠছে লুৎফর ভাইর সঙ্গে নানা স্মৃতি। লুৎফর ভাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার সাথে সাক্ষাৎ হলে চা-পান না খাইয়ে ছাড়তেন না। আমি কখনো বিল দিতে গেলে বলতেন ‘অন্য সময় দিস’। তাঁর নিকট কেউ আমার পরিচয় জানতে চাইলে বলতেন আমর ছোট ভাই। আজ অনুভব করছি যারা মানুষকে আপন অন্তরে ধারণ করতে পারেন, মানুষ শুধু তাদেরই আত্মার আত্মীয় হয়। সু-সময় ও দু-সময়ে সঙ্গী হয়। আর সেই মানুষ স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। কেউ তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করলে ব্যাবহার গুণে ধীরে ধীরে তাকে আপন করে নিতেন। আমি তাঁর কাছে শিক্ষনীয় অনেক কথা শ্রবণ করেছি। তিনি বলতেন, আমরা দেশকে ভালোবাসবো, মানুষকে ভালোবাসবো, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে জানাবো বিনীত সালাম।

মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা, মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার উপায় নেই। তবুও কিছু মৃত্যু আছে মেনে নেয়া কষ্টকর-বেদনার্ত। তেমনি লুৎফর ভাইর মৃত্যু। কী দিয়ে শান্তনা দিব ঝরনা ভাবীকে। কীভাবে তিনি মেনে নেবেন স্বামীর অকাল মৃত্যু! সেদিন ঝরনা ভাবীকে শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজে পাইনি।

সমবেদনার ভাষা কারো ছিল না। বাবা-মা’র পরম ভালোবাসায় বেড়ে ওঠেছে একমাত্র ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রত্যাশি জামিনূর রহমান জেমস, ভূঞাপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত জমজ দুই মেয়ে নুসরাত জাহান রিতু ও ইসরাত জাহান জিতু। ওদের গভীর মমতা- অনাবিল আদর দিয়ে শোক ঘোঁচাতে হবে স্বজনদের। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে লুৎফর ভাইর অবর্তমানে ভাবী যাতে পরিবারের হাল ধরতে পারেন সে জন্য সহযোগীতা করতে হবে। জানি ভাবী শোককে শক্তিতে পরিণত করে আদর্শিক পারিবারিক পরিম-ল টিকিয়ে রাখতে প্রচেষ্টা চালাবেন নিরন্তর।

পাশের গ্রাম ভূঞাপুর উপজেলার কাগমারীপাড়া এলাকার ছাত্র-যুবকদের সমন্বেয়ে ‘মৌসুমী ক্রিড়া সংঘ’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় জড়িত ছিলেন লুৎফর রহমান। তিনি সংঘঠনটির সহ-সভাপতি ছিলেন। এ সংগঠনের উদ্যোগে নিয়মিত বিভিন্ন খেলার আয়োজন হত। বয়বৃদ্ধদের হা-ডু-ডু ও ফুটবল খেলার আয়োজন করে সমগ্র জেলায় আলোড়ন সৃষ্ঠি করেছিল সংগঠনটি।

বিল ঘেরা ডাকিয়াপটল নামে যে গ্রামটিতে লুৎফর রহমান জন্মে ছিলেন সেই গ্রাম থেকে বাংলার রূপ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। বর্ষাকালে ঘুম থেকে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত বিলের মধ্যে শাপলা ফুলের সমারোহ, কার্তিকে পানি কমে যাওয়ার পর মাটির নিচ থেকে শালুক তোলা ও বর্ষায় পানির সাথে পাল্লা দিয়ে আমন বাড়তে দেখেছেন লুৎফর রহমান। এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করে প্রকৃতির মত উদার হয়েছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের দুটি ঘটনা তুলে ধরছি। যা তাঁর ঘনিষ্ঠজন লিটন খাঁ’র কাছ থেকে শোনা। একদিন একটি মোরগ লুৎফর ভাইর মোটরসাইকেলে চাপা পড়ে। তিনি মোরগটি জবাই করে মালিক খুঁজে বের করে পাঁচশ’ টাকা ও জবাইকৃত মোরগটি তার হাতে তুলে দেন। আরেকদিন ভূঞাপুরের পলিশা নামক স্থানে ৫-৬ বছরের একটি ছেলেকে এক মোটরসাইলেক চালক ধাক্কা দিয়ে আহত করে চম্পট দেয়। লুৎফর ভাই রক্তাক্ত ছেলেটিকে পাঁজা-কোলে তুলে স্বজনদের খোঁজেন। স্বজন খুঁজে না পেয়ে লুৎফর ভাই হাসপাতালে ভর্তি করে ছেলেটির চিকিৎসা করান। পরে স্বজনরা এসে চিকিৎসার খরচ দিতে চাইলে লুৎফর ভাই বলেন, ‘ছেলেটি যদি আমার হত?’

দক্ষিণ লোকেরপাড়া ঈদগাঁ মাঠে লুৎফর ভাইর জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ ঈদগাঁ মাঠের এ যাবৎ কালের জানাজা সাক্ষ্য দিবে এরচেয়ে বড় জানাজা আর কোনটিই হয়নি। জানাজা নামাজে মানুষের যে ঢল নেমেছিল তাতেই প্রতীয়মান হয়- কতটা আপন মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি সর্বস্তরের মানুষের গভীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নিজ গ্রামের গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন, আমিন।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno