আজ- ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  রাত ৯:০৯

ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে সার্বজনীন উৎসব বৈশাখের আগমণ

 

বুলবুল মল্লিক:

বাঙালি বৈশাখ এলো! পুরনো সে জরা কাটেনি। বিয়োগ ব্যথা, বিচ্ছিন্নতার কষ্ট, বেঁচে থাকার সংগ্রাম সবই তীব্র হয়েছে। অযুত টানাপোড়েনের মাঝেই ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে বৈশাখ।

আজ বুধবার ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রথমদিন, ১৪ এপ্রিল খ্রিস্টাব্দ। বাঙালিত্বের গভীর বোধে জেগে ওঠার নতুন বছর। শুভ নববর্ষ।

আজকের একমাত্র প্রার্থনা- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা।’ শুদ্ধ সুন্দর এ চাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বছরে নব সূচনা করবে বাঙালি। বিগত দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে চোখ মেলে তাকাবে।

এবার এমন এক সময় নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া হবে যখন করোনা ছাড়াও দানবের চেহারায় সামনে এসেছে মৌলবাদ। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা স্বাধীনতার ৫০ বছরের যত অর্জন সব গিলে খেতে চাইছে। এমন বাস্তবতায় প্রতিবাদ প্রতিরোধের মানসকে জাগিয়ে দিতে এসেছে বৈশাখ।

নজরুলের ভাষায়- তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর…। উদার অসাম্প্রদায়িক উৎসবের পক্ষে জয়ধ্বনি করবে আজ বাংলাদেশ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তার আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সাল।

এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। বঙ্গাব্দের মাস হিসেবে বৈশাখের প্রথম স্থান অধিকার করার ইতিহাসটি বেশিদিনের না হলেও, আদি সাহিত্যে বৈশাখের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। দক্ষের ২৭ কন্যার মধ্যে অনন্য সুন্দরী অথচ খরতাপময় মেজাজসম্পন্ন একজনের নাম বিশাখা।

এই বিশাখা নক্ষত্রের নামানুসারেই বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখের নামকরণ। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সেখানেও সন্ধান মেলে বৈশাখের।

আবহমানকাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় আল্পনা আঁকেন মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন সবাই।

স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন।

আজ হাটে-মাঠে-ঘাটে বসবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। নানা রকম কুটিরশিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে স্টল সাজানো হবে। বিভিন্ন এলাকায় থাকবে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।

নাগরিক জীবনেও বিপুল আনন্দ যোগ করে পহেলা বৈশাখ। বর্ষবরণের দিন সব শহরেই আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের। ধর্ম বর্ণ ভেদ ভুলে অসাম্প্রদায়িক উৎসবে মাতে বাংলা।

ষাটের দশকে বাঙালী চেতনাবিরোধী অবস্থানের প্রতিবাদে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে শুরু হয় বৈশাখ উদ্যাপন। এর মাধ্যমে বাঙালী আপন পরিচয়ে সামনে আসার সুযোগ পায়।

পরবর্তী সময় বাঙালীর রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে পহেলা বৈশাখের। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিবসটি বর্তমানে বাঙালীর জাতিসত্তায়, চেতনায় ও অনুভবের জগতে গভীরভাবে বিরাজ করছে।

অবশ্য গত বছরের মতো এবারও সংক্রমণ থেকে বাঁচতে শহর নগর গ্রাম দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছে। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ নেই। একে অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে চলেছে শুধু।

এ অবস্থায় আজ বর্ষ শুরুর দিনে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিয়েও মানসিকভাবে পরস্পরের কাছে থাকার শপথ নেবে বাঙালি।

রমনার বটমূলে যাওয়া হবে না। ছায়ানটের শিল্পীদের সঙ্গে গান গাওয়া হবে না। রূপ বদলেছে মঙ্গল শোভাযাত্রাও। তাতে কী? বাঙালি তার মনের রং ধরে রাখতে জানে। মনের রংয়েই রঙিন হয়ে ওঠবে পহেলা বৈশাখ। ভবিষ্যতে আরও সুন্দর আরও বর্ণাঢ্য নববর্ষ উদ্যাপনের স্বার্থে এবারও ঘরে বসে নিজেদের মতো করে উদ্যাপন করবে বাঙালি।

বর্ষবরণের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এবার শোভাযাত্রা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ।

কথা ছিল ক্যাম্পাসের ভেতরে মাত্র ১০০ জনের অংশগ্রহণে প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হবে। সে লক্ষ্যে চারুকলার দেয়াল লোকচিত্রে সাজিয়ে নিয়েছিলেন শিল্পীরা।

একই সময় মুখোশ সরাচিত্রসহ বিভিন্ন লোকজ অনুসঙ্গ নিয়ে তৈরি হচ্ছিলেন শোভাযাত্রার জন্য। কিন্তু হায়! সবই যখন প্রস্তুত তখন সরকারি নির্দেশে বাতিল হয়ে যায় রঙিন উৎসব।

একদিন আগেও ঢাকার রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করেছে। অথচ রাত পোহালে যে বৈশাখ, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতীকী মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা গেল না।

তবে আয়োজকরা জানিয়েছেন, শোভাযাত্রা ঘিরে যে উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়েছিল সেটি ক্যামেরাবন্দী করে টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হবে।

এদিকে গত কয়েকদিন ধরেই বর্ষবরণ উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছে রাজধানীর উৎসবপ্রেমী মানুষ। যে যার মতো করে কেনাকাটাও সেরে রেখেছেন। বাকিরা পুরনো শাড়ি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েই ঘরোয়া আয়োজনে উৎসব উদ্যাপন করবেন।

সক্রিয় হবেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। গত কয়েকদিনের প্রস্তুতি দেখে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

সবমিলিয়ে একেবারে ফিকে হবে না বৈশাখের রং। হৃদয়ের আবেগ দিয়ে আল্পনার মতো বাঙালী সাজিয়ে নেবে তার বৈশাখ। আজকের দিনে আমাদের তা-ই প্রত্যাশা। শুভ নববর্ষ।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno