আজ- ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  রাত ৪:৩০

জাতীয় পার্টিতে নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা

 

দৃষ্টি ডেস্ক:

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে চলমান অস্থিরতা এখন ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটির নেতৃত্বে কে থাকবেন- তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা হিসাবনিকাশ। চলছে অন্তঃকলহ, বহিষ্কার ও শক্তি প্রদর্শনের লড়াই।

আর এই লড়ায়ের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এবং দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।

এর মধ্যে রওশন এরশাদ যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে থেকে নির্বাচন করার পক্ষে। অন্যদিকে বেশ কিছু দিন ধরে জি এম কাদের ইভিএম কিংবা বর্তমান সংবিধান মতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার বিষয়ে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে আসছিলেন। তবে গত শনিবার(৮ অক্টোবর) পার্টির প্রেসিডিয়াম বৈঠকের পর সুর পাল্টেছেন তিনি। এখন জিএম কাদেরও বর্তমান সংবিধান মেনে তিনশ আসনে নির্বাচন করার কথা ভাবছেন। এ অবস্থায় দলটির শ্যাম ও কুল দুটিই রক্ষা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


জাতীয় পার্টির বিবাদমান দুই পক্ষের (রওশন ও জিএম কাদের) মধ্যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। সামনের নির্বাচনে কোন প্রেক্ষাপটে পার্টির ভূমিকা কী হবে, কোন পক্ষের সঙ্গে সুর মেলাবে- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে, নাকি সরকার ক্ষমতার বাইরে থাকা অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সঙ্গে? নাকি নিজেদের মতো করে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে? এসব প্রশ্নের একটি কমন উত্তর সম্প্রতি দলটির চেয়ারম্যান কিংবা মহাসচিব বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে দিয়ে আসছিলেন।

তা হলো- নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত দলটি তাকিয়ে আছে, সামনের দিনের রাজনৈতিক গতিবিধির দিকে। যাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখবে, শেষমেশ তাদের দিকেই ঝুঁকবে দলটি।


এক্ষেত্রে দলের চেয়ারম্যান কিংবা মহাসচিবের সিদ্ধান্তের বাইরে ব্যতিক্রম রওশন এরশাদ। তিনি যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে থেকে নির্বাচন করার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। তার সঙ্গে ভেতরে ভেতরে দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্যও রয়েছেন বলে জানা যায়। তবে এ পরিস্থিতিতে দুই পক্ষই সরকারপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।

জিএম কাদের অনুসারীরা মনে করছেন, রওশন এরশাদকে ক্ষেপিয়ে তোলার পেছনে সরকারের ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া দল থেকে অতীতে বাদ পড়া কয়েকজন নেতারও ইন্ধন আছে। যেহেতু জিএম কাদের সরকারের বিরুদ্ধে এখন আগের চেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, সে কারণেই সরকার রওশন এরশাদকে মাঠে নামিয়েছে।

২০১৪ এর নির্বাচনের আগেও রওশন এরশাদকে সরকারই মাঠে নামিয়েছিল এবং সেই কারণেই এরশাদের নির্বাচন বর্জনের আহ্বান পুরোপুরিভাবে সফল হয়নি, জাতীয় পার্টি সংসদে গেছে। এখন আবার একইভাবে সরকার রওশন এরশাদকে ব্যবহার করছে। জিএম কাদের আগামী নির্বাচনে সরকারি বৃত্তের বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করলে যেন বিকল্প হিসেবে রওশন এরশাদকে ব্যবহার করতে পারে, সে পথও তৈরি করে রাখতে কাজ করছে সরকার।


এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার প্রভাবশালী একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানিয়েছেন, সরকার যদি রওশন এরশাদকে সমর্থন দেয় এবং দলের যারা এমপি আছেন, তাদের যদি আগামীতে এমপি করে আনার প্রলোভন দেওয়া হয় তাহলে কেউ কেউ জিএম কাদেরের সঙ্গ ছেড়ে চলে যাবেন। কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেরই এমপি হওয়ার ইচ্ছা আছে। ফলে তারা প্রলোভনে পড়ে রওশন এরশাদের দলে যোগ দেবেন।

রওশন এরশাদকে সরকার সমর্থন দিতে পারে বিষয়টি বুঝতে পেরে শনিবার (৮ অক্টোবর) দলের প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভা ডাকা হয়। সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। জানা যায়- সভায় ৪১ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের মধ্যে ৩৮ জন এবং ২৬ এমপির মধ্যে ২০ জন উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত থাকা এ প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, তারা সরকার ও রওশন এরশাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছি।

এ কারণেই আগামী নির্বাচনে কারো পক্ষে না গিয়ে সংবিধান মেনে ৩০০ আসনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। একদিকে সরকারকে খুশি রাখা, অন্যদিকে রওশন এরশাদের দুরভিসন্ধিমূলক চেষ্টা বিফল করে দেওয়া। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ কারো সঙ্গে আমরা জোটে নেই, আলোচনায়ও নেই। কোনো জোটের প্রশ্নই আসে না।

জাতীয় পার্টি নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে ভোট করব। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আমরা মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছি। শনিবার দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভা শেষে জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।


এদিকে, চিকিৎসা শেষে ব্যাংকক থেকে চলতি মাসেই (অক্টোবর) দেশে ফিরে আসার কথা রয়েছে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের। তার দেশে ফেরার পরই নতুন করে ভাঙ্গার গুঞ্জন রয়েছে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দলটিতে। জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা বলছেন, দলের বর্তমান চেয়ারম্যান ও এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) বাদ দিয়ে আগামী ২৬ নভেম্বর দলের সম্মেলনের ডাক দেন ভাবি রওশন এরশাদ।

অন্যদিকে, জাপার বর্তমান চেয়ারম্যান বলছেন, দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক রওশন এরশাদের সম্মেলন ডাকার এখতিয়ার নেই। এরপরই দলে রওশনপন্থি প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে অন্তঃকোন্দল দেখা দিয়েছে।

বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুটি গ্রুপে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপেক্ষাকৃত দুর্বল রওশনপন্থিরা যদি সরকারের সমর্থন পায় তাহলে রওশন এরশাদ দেশে ফিরে এসে সম্মেলন করতে চাইলে আবারো ভাঙবে জাতীয় পার্টি। এ অবস্থায় জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ তাদের পাল্লাভারি করতে দলের হেভিওয়েট নেতাদের পক্ষে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চালাচ্ছেন চেষ্টা তদবির। এর ফলে প্রতিনিয়ত চলছে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য-বিবৃতি। দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও।


এদিকে রওশনপন্থিদের দাবি, আপাতত দুর্বল মনে হলেও রওশন এরশাদ দেশে ফিরে এলে এ চিত্র পাল্টে যাবে। এখন যারা দলে জিএম কাদেরপন্থি বলে পরিচিত তারা অনেকে রওশন এরশাদের কাছে চলে আসবেন। এখনো অনেক সংসদ সদস্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

তারা বলছেন, জিএম কাদের দলের গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা অনুযায়ী তাদের বহিষ্কারের ভয় দেখাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, কেউ জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে গেলে তাকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ারও ভয় দেখানো হচ্ছে! যে কারণে সংসদ সদস্যরা ভয়ে চুপ আছেন। কিন্তু যখন রওশন এরশাদ দেশে আসবেন এবং সরকারের পুরোপুরি সমর্থন পেয়ে যাবেন, তখন জাতীয় পার্টির অনেক সংসদ সদস্য রওশন এরশাদের দলে ভিড়বেন। জিএম কাদের চাইলেও সে সময় কিছু করতে পারবেন না।


এ বিষয়ে রওশন এরশাদ ঘোষিত সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব ও তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বলেন, ম্যাডামকে এ মাসেই ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলে তার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। আশা করছি, তিনি চলতি মাসেই দেশে ফিরে আসবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজও একজন এমপি (সংসদ সদস্য) আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

তিনি বলেছেন, জিএম কাদের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের দল থেকে বহিষ্কার এবং আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের চুপ করিয়ে রেখেছেন। এ কারণে এখন তারা কিছু বলছেন না। রওশন এরশাদ দেশে ফিরে এলে সবাই তার সঙ্গে থাকবেন এবং দলের সম্মেলনে অংশ নেবেন।

রওশন এরশাদ দলে বিদ্রোহ চান না জানিয়ে গোলাম মসিহ বলেন, তিনি চান যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে সবাইকে নিয়ে দলকে আরও শক্তিশালী করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে। এ কারণেই সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন। আশা করি, তিনি দেশে ফিরলে সবাইকে নিয়ে বসে এর সমাধান করতে পারবেন।


অন্যদিকে, জিএম কাদেরপন্থি নেতারা বলছেন, রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে জিএম কাদেরকে কিছু নাম দেওয়া হয়েছিল। মূলত যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাদের দলে ফিরিয়ে নিতে। তবে, বিষয়টি বিবেচনাধীন। তারা আরও জানান, বর্তমানে রওশন এরশাদের সঙ্গে যে দুজন আছেন (গোলাম মসীহ ও কাজী মামুনুর রশীদ) তারা কিছুই করতে পারবেন না, যদি সরকারের পক্ষ থেকে সমর্থন দেওয়া না হয়।

এখন রওশন এরশাদ দেশে ফিরে এলে এবং সরকার যদি তাদের সমর্থন দেয় তাহলে বর্তমানে যারা জিএম কাদেরের সঙ্গে আছেন তাদের কেউ কেউ রওশন এরশাদের সঙ্গে ভিড়তে পারেন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, শনিবারের প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে রওশন এরশাদ যাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তাদের মধ্যে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় কয়েকজনকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।

জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যানই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি। অব্যাহতি দেওয়া বা বহিষ্কার করা নেতাদের দলে ফিরিয়ে নিতে তেমন কোনো অসুবিধা আমি দেখি না। বরং তাদের ফের দলে ভেড়ালে জাতীয় পার্টি ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। অন্যথায়, আবারো ভাঙনের মুখোমুখি হবে দলটি।

এ বিষয়ে দলটির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে। কাউন্সিলেই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানকে দল পরিচালনার সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দলে কোনো বিভেদ নেই।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno