আজ- ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার  সকাল ৮:১৮

দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে নদী খাল বিল-১ :: পাল তুলে নৌকা আর চলে না

 

বুলবুল মল্লিক:


‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’- এই প্রবাদেই পরিচয় মেলে এক সময়ের টান-আইল তথা টাঙ্গাইলের। কিন্তু কালের আবর্তে এ প্রবাদটি হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই নদী চর খাল বিল এখন আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। ক্রমাগত দখল দূষণ আর ভরাট হয়ে টাঙ্গাইল জেলা দিয়ে প্রবাহিত নদী, শাখা নদী ও খাল বিলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। জেলার নদী, খাল, বিল দিয়ে এখন আর পাল তুলে নৌকা চলতে দেখা যায়না।
উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র এবং সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ৩৪১৪.৩৫ বর্গ কিমি আয়তনের টাঙ্গাইল জেলার প্রধান নদী রয়েছে মোট ১০টি। সেগুলো হচ্ছে যমুনা, ধলেশ্বরী, বংশাই, লৌহজং, খিরু, যুগনী, ফটিকজানি, এলেংজানি, লাঙ্গুলিয়া ও ঝিনাই। এছাড়া বৈরান, টোক, নাংলাই সহ আরো কিছু শাখা নদী জেলার অভ্যন্তরে প্রবাহিত হচ্ছে। টাঙ্গাইলে খালের মধ্যে রয়েছে কুচিয়ামারার খাল, নয়ার খাল, মইষাখালীর খাল, ময়থার খাল, বেংড়া খাল, খসরুখালির খাল প্রভৃতি। এসব খাল প্রায় ক্ষেত্রেই নদীর শাখা রূপে সৃষ্টি হয়ে আবার নদীতেই মিশেছে। বিলের মধ্যে বালিয়া বিল, কাউলজানী বিল, ডুবাইল বিল আকারে কিছুটা বড়। এছাড়া চাপড়া বিল, দেও বিল, পদ্ম বিল, চারান বিল, নকুলবিল, কুমরি বিল, চাটাই বিল, বারকাটি বিল, বার্থা বিল ইত্যাদি সহ আরো ছোট ও মাঝারি আকারের বিল জেলায় বিদ্যমান। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে এসব খাল ও বিলের অধিকাংশই দখল হয়ে ব্যক্তি মালিকানায় ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে, কোথাও কোথাও ঘর-বাড়ি ওঠেছে। ফলে অবয়ব পরিবর্তিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নদীগুলোর মধ্যে যমুনা হচ্ছে সর্ববৃহৎ ও লৌহজং নদীটি টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে। ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশাই, বৈরান, এলেংজানি সহ অন্য নদীগুলো জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রবাহিত।
প্রমত্ত্বা যমুনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর একটি। এটি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রধান শাখা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং-৭৬। যমুনা গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীর সাথে মিশেছে। যমুনা নদীর আগে নাম ছিল জোনাই। ১৭৮৭ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নদী নতুন খাতে প্রবাহিত হয়ে যমুনা নদীর সৃষ্টি করেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে যমুনার দৈর্ঘ্য ২৪০ কিলোমিটার। যমুনা নদীর সর্বাধিক প্রস্থ ১২০০ মিটার(আরিচা)। যমুনার প্রধান উপ-নদী গুলো হচ্ছে তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, সুবর্ণশ্রী। করতোয়া নদী যমুনার দীর্ঘতম এবং বৃহত্তম উপ-নদী। যমুনা নদী টাঙ্গাইল জেলার পশ্চিমাংশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এটি এখনও প্রমত্ত্বা, প্রবল খর¯্রােতে প্রতিবছর বর্ষাকালে ঘর-বাড়ি, ক্ষেত-খামার, জনবসতি ভেঙে ফেলে। যমুনা মূলত: উত্তরবঙ্গের সাথে টাঙ্গাইলকে পৃথক করেছে- সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে বঙ্গবন্ধুসেতু।
ধলেশ্বরী নদী যমুনা নদীর একটি শাখা। এটি বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের টাঙ্গাইল জেলা, মানিকগঞ্জ জেলা, ঢাকা জেলা নারায়ণগঞ্জ জেলা এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৯২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৪৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং-২৭। নদীটি মূলত বাংলাদেশের মধ্যভাগে দিয়ে প্রবাহিত একটি জলধারা।

ধলেশ্বরী নদীতটের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বোরো আবাদ হচ্ছে।

টাঙ্গাইল জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে যমুনা নদী থেকে ধলেশ্বরীর সূচনা। এটি উৎপত্তিস্থল থেকে কিছুদূর এগিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়- উত্তরের অংশটি ধলেশ্বরী আর দক্ষিণের অংশটি কালীগঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়। এই দুইটি শাখা নদী মানিকগঞ্জ জেলার কাছে মিলিত হয়ে সম্মিলিতভাবে এই জলধারাটি ধলেশ্বরী নামে প্রবাহিত হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে মিলিত হয় এবং পরবর্তীকালে মেঘনা নদীতে পতিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, ধলেশ্বরী বর্তমানে যমুনার শাখা হলেও প্র্রাচীনকালে এটি সম্ভবত পদ্মা নদীর মূল ধারা ছিল। ১৬০০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পদ্মার গতিপথ ব্যাপকভাবে পাল্টে গেছে। ধারণা করা হয়, কোনো সময়ে পদ্মার মূল ধারাটি রামপুর-বোয়ালিয়া এলাকা ও চলন বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর মাধ্যমে মেঘনায় গিয়ে মিশতো। ১৮শ’ শতকে পদ্মার নি¤œ প্রবাহটি ছিল আরো দক্ষিণে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মূল প্রবাহ ধলেশ্বরী থেকে দক্ষিণের প্রবাহে, তথা কীর্তিনাশা নদীতে সরে যায়- যা বর্তমানে পদ্মার মূল গতিপথ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ে যমুনার কালিহাতী উপজেলার জোকারচরে স্থানীয়দের ভাষায় ‘নিউ ধলেশ্বরী’ নামে যে নদীটি দেখা যায় তা ধলেশ্বরী নদীরই পরিবর্তিত রূপ।
লৌহজং নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৮৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং- ৫৪। লৌহজং নদীটি পূর্র্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সরাসরি দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে। এই নদী অববাহিকার আয়তন ১০৪ বর্গ কিমি। লৌহজং যমুনার শাখা নদী। ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারায় উৎপত্তি হয়ে ভূঞাপুর উপজেলা সদরের এক কিমি. উত্তরে পাঁচটিকরীতে ঝিনাই নদীর সাথে মিশে দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখী হয়েছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ঢালান শিবপুর থেকে নদীটি টাঙ্গাইল শহর, করটিয়া, বাসাইল সীমান্ত দিয়ে মির্জাপুর-জামুর্কী হয়ে বংশাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। টাঙ্গাইল শহরের উপর দিয়ে বয়ে চলা এই নদীর দু’পাশে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি। এতে লৌহজং নদী দখল ও দূষণে সরু খালে পরিণত হয়। দীর্ঘ ৫০ বছর পর বিগত ২০১৬ সালে টাঙ্গাইলের লৌহজং নদী রক্ষার জন্য তৎকালিন জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে টাঙ্গাইলের জনসাধারন। শহরের এক কিলোমিটার এলাকার দখল ও দূষণ মুক্ত করা হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব হোসেন বদলি হওয়ার পর আবারও দখল-দূষণের শিকার লৌহজং।
টাঙ্গাইলের নদীগুলোও দখল, দূষণ আর ভরাট হয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। এক সময় এসব নদী দিয়ে বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার চলাচল করত। এখন শুস্ক মৌসুমে অনেক জায়গায় নদীর তলদেশে ধান চাষ করা হচ্ছে। টাঙ্গাইলে প্রবাহিত ধলেশ্বরী নদীর পোড়াবাড়িতে বিশাল এলাকাজুড়ে লঞ্চ ঘাট ছিল। লঞ্চ ঘাটকে ঘিরেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। পোড়াবাড়ির লঞ্চঘাটের পানি মিষ্টি তৈরিতে অনন্য স্বাদ এনে দেয়ায় ‘পোড়াবাড়ির চমচম’ বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। ধলেশ্বরী নদী এখন প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষা মৌসুম ছাড়া নাব্যতা থাকে না। লঞ্চ, স্টিমার চলাচল তো দূরের কথা; ভরা বর্ষায়ও নৌকা চলা ভার। (ক্রমশ:)

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno