আজ- ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ শনিবার  সকাল ১০:২৫

বনগ্রামের গণহত্যা : মহান মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল

 

*লিয়াকত আলী*

মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগৃহীত ছবি

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে হিংস্র নরঘাতক পাকিস্থানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র ও নিরপরাধ বাঙালির ওপর আকস্মিক হামলা ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। মূলত তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অতঃপর টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত নাগরপুর থানাধীন গয়হাটা ইউনিয়নের বনগ্রাম নামক একটি গ্রামে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত জয়নূল আবেদীন ও আর্মিম্যান আমির হামজার নেতৃত্বে ১২১ সদস্য বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সংগঠিত হয়। যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জয়নূল আবেদীন পরবর্তীতে ‘জয়নাল কমান্ডার’ নামে পরিচিতি পান।


১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার চৌহালী থানায় অবস্থানরত পাক-হানাদার বাহিনীর একটি দল বনগ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটিতে আক্রমণের উদ্দেশ্যে বনগ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কূল ঘেষে মর্টারসেল সহ ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। এ খবর পেয়ে জয়নূল কমান্ডার ও আমির হামজার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়।

ওই আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং হানাদারদের একজন মেজর ও একজন সৈন্য নিহত হয়। এ যুদ্ধে জয়লাভ করে জয়নূল কমান্ডার ও তাঁর বাহিনীর মনোবল আরও বৃদ্ধি পায় এবং দেশ-মাতৃকা রক্ষার জন্য পাক হানাদার বাহিনীকে দেশ থেকে চির-বিদায় দেওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। হানাদার বাহিনীর পরাজয় ও নিহতের খবর পেয়ে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানায় অবস্থানরত পাক-হানাদার বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং বনগ্রাম আক্রমণ ও নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।


স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী নাগরপুর থানায় ক্যাম্প করেছিল। সেই ক্যাম্পে শুধু পাকিস্থানী আর্মিই ছিল না; পাকিস্থানী পুলিশ, বন বিভাগের অস্ত্রধারী সদস্য, স্থানীয় আনসার ও রাজাকার বাহিনীও ছিল। এই ক্যাম্পের প্রধান ছিল পাকিস্থানের তরুণ আর্মি অফিসার মেজর গোলাম খান। তারই নির্দেশে সমগ্র নাগরপুরে বিশেষ করে গয়হাটা ইউনিয়নে তথা গয়হাটায় লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ, জ¦ালাও-পোড়াও সহ নানা অপকর্ম করা হয়েছে।


রক্তপিপাসু নরঘাতক, নারী ধর্ষক মেজর গোলাম খান ২০ অক্টোবর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করার নিমিত্তে ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর আনুমানিক সকাল ৮টার দিকে আধুনিক ও ভারী অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হায়েনার দল নিয়ে বনগ্রামে এসে হাজির হয়। বনগ্রাম যাবার পথে গয়হাটা ও বনগ্রামের মাঝপেেথ অবস্থিত একটি নদী পারি দিতে হয়। সেই নদীতে খেয়া পারাপার করে দিতেন যোগেন্দ্র মাঝি নামে একজন অসহায় দরিদ্র লোক। তাকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে চলে আসে বনগ্রাম।

বনগ্রামে এসেই নিরীহ ও নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হানাদার বাহিনীর আক্রমণের বার্তা পেয়ে জয়নূল কমান্ডারের বাহিনী আমির হামজার নেতৃত্বে হানাদার মোকাবেলা করার জন্যে কর্দমযুক্ত ও ধানী জমিতে অবস্থান গ্রহণ করে এবং কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। আমির হামজার নিকট পিছু হটার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের যুদ্ধে অবস্থাগত কৌশল ভুল ছিল বিধায় পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তিনি আরও জানান, এই ভুলের কারণেই ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান এবং বিপক্ষের একজনেরও প্রাণ হারায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটার সাথে সাথে হায়েনার দল পুরো বনগ্রাম ঘিরে ফেলে। নেমে আসে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঘোর অন্ধকার। শুরু হয় ইতিহাসের নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর গণহত্যা। যাকে যেখানে যেভাবে পেয়েছে হায়েনারা সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে। কাউকে ঘরের ভেতর, কাউকে পলায়নরত অবস্থায় পাখিরমত গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

খোদাবক্স হাজী নামক একজন বয়স্ক ব্যাক্তিকে তার ঘরের ভেতর ঢুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় এবং তার স্ত্রীকে বেয়নেটের আঘাতে দেহ ছিন্নভিন্ন করে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেহ দুটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু হত্যা করেই তাদের রক্তের পিপাসা মিটায়নি- সমস্ত বনগ্রাম পুড়িয়ে ছাড়-খার করে দেয়। এই জালিমদের হাত থেকে যারা রক্ষা পেয়েছিলেন তাদের আর মাথাগুজার ঠাঁইটুকুও বাকি ছিলনা।


বনগ্রামের হত্যাযজ্ঞ শেষ করে জালিমরা চলে যায় বৈন্যা নামক পাশের গ্রামে যেখানে ২০ অক্টোবর জয়নূল কমান্ডারের নেতৃত্বে জালিমদের দুইজনকে হত্যা করা হয়েছিল সেই গ্রামের দুলাল সরকারের বাড়িতে বৈন্যা ও বনগ্রামের বেশ কিছু লোক নিরাপদ মনে করে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাদের একজনও জালিমদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। শতাধিক মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে ওরা এবং তার মধ্যে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল যা আগেই বলা হয়েছে।

বনগ্রাম গণকবরে ৫৭ জন নিহতদের তালিকা ফলকে রয়েছে। যে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন তারা হচ্ছেন- ১. আব্দুল লতিফ, সখিপুর, টাঙ্গাইল, ২. মোফাজ্জল হোসেন, সখিপুর, টাঙ্গাইল, ৩. জাহাঙ্গীর আলম, পিতা-সরিয়ত আলি, গজারিয়া,মুন্সিগঞ্জ, ৪. আব্দুল হামিদ, পিতা- আয়াত আলি, বালুয়া কান্দি, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ, ৫. তারা মিয়া, পিতা-এনায়েত উল্লাহ্, নাগরপুর, টাঙ্গাইল, ৬. আক্তারুজ্জামান, গজারিয়া, মুন্সিগঞ্জ। তিনজন মুক্তিযোদ্ধাদের পিতার নাম পাওয়া যায়, বাকি তিন জনের পাওয়া যায়নি।


জালিমদের হাত থেকে যারা রক্ষা পেয়ে ছিলেন তারা হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংস দেখে দিশেহারা হয়ে যান। এই অবস্থায় সকলে মিলে নিহতদের লাশ দাফন ছাড়াই বনগ্রাম গোরস্থানে তিন-চারজন করে এক একটি কবরে সমাধিস্থ করেন। বনগ্রামের অবস্থা এমন দ্বারায় যে- স্বামী হারা স্ত্রী, স্ত্রী হারা স্বামী, সন্তান হারা মা, বাবা হারা পুত্র-কন্যা এবং গৃহ হারা বনগ্রামবাসীর হাহাকার এ যেন শোকের ছায়ায় সকলেই মুহ্যমান। অনাহারে, অর্ধাহারে, দিন কাটতে থাকে জীবন্ত লাশদের। এ শোক যেন শুধু বনগ্রাম বাসীর নয়, এ যেন সমগ্র বাংলাদেশের।


যেভাবে মেজর গোলাম খানেরা বাংলার মা বোনদের ইজ্জত কেড়ে নিয়েছে, নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষদেরকে হত্যা করেছে, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে গৃহহারা করেছে- তাতে বিশ^বাসী বিস্ময়ে বিস্মিত হয়েছে। এ যেন চেঙ্গিস খানের কিংবা হালাকুখানের গণহত্যাকেও হার মানায়। স্পেনে যেমন খ্রিষ্ট্রান নেতাদ্বয় ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার নির্দেশে তাদের দেশের মুসলিম নিধন করা হয়েছিল, সম্প্রতি মায়ানমারের জান্তাদের নির্দেশে যেমন আরাকান রাজ্যের মুসলিম হত্যা করা হয়েছে তার চেয়েও জঘন্য কায়দায় বনগ্রাম বাসীদেরকে হত্যা করা হয়।


বনগ্রামের ঘটনাটি ছিল খুবই নির্মম, পাশবিক, ও হৃদয় বিদারক একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্বরোচিত ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের আরও একটি কাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সংযোজিত হয়। এতদসত্ত্বেও বাংলার ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, বাঙালিরা কখনও দখলদারীর দখল কিংবা দাসত্ব মেনে নেয় নি, এমনকি আপোষও করেনি। জীবন দিয়েছে তবু পরাজয় স্বীকার করেনি। ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে।


বলা যায়, ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিরীহ জনগন ও মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনদানের কথা, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিতুমীরের আত্মত্যাগ, মাস্টার দ্য সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ আরও অসংখ্য বাঙালি রয়েছেন যারা বাংলার ইতিহাসে অপরাজেয় স্বাক্ষরবহন করে চলেছেন।


মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম বনগ্রাম। দেশের জন্য যে গ্রামের মানুষের এত অবদান, এত রক্ত ঢেলে দেওয়া, এত ধ্বংসলীলা সেই গ্রামের জন্য আজ পর্যন্ত কোন সরকারই শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কোন অবদান রাখেননি। ১৯৭২ সালে শহীদদের স্মৃতির স্মরণে গ্রামের সাধারণ মানুষ মিলে ‘বনগ্রাম শহীদ মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। সেই থেকে অদ্যাবধি বিদ্যালয়টি অবহেলিতই রয়ে গেছে।

এমনকি শহীদদের স্মরণে কোন শহীদ মিনার কিংবা কোন স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত করা হয়নি। বেশিরভাগ সময় গণকবরটিও অযতেœ অবহেলায় থাকে। কেবলমাত্র ২৫ অক্টোবর ‘গণহত্যা দিবস’ এলেই বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা বনগ্রামের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করার জন্য গণকবরে আসেন। কিন্তু শহীদ পরিবারের কি অবস্থা বা কি অবস্থায় তারা আছেন সেদিকে কারও খেয়াল নেই বললেই চলে। মাগফেরাত কামনার জন্য গণকবরে যাওয়া- আসার তেমন কোনো রাস্তা নেই।


মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বহাল রাখার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর নিকট বনগ্রামবাসী তথা নাগরপুরবাসী জোরদাবী শহীদদের নামে বিদ্যালয়টিকে সরকারিকরণ, বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার জন্য রাস্তা নির্মাণ, শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার ও গণকবরে যাওয়া-আসার রাস্তা নির্মাণ করে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা হোক।


-লেখক, সহকারী অধ্যাপক, নাগরপুর মহিলা কলেজ, টাঙ্গাইল।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করেছে

 
 
 
 
 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক : মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
আশ্রম মার্কেট ২য় তলা, জেলা সদর রোড, বটতলা, টাঙ্গাইল-১৯০০।
ইমেইল: dristytv@gmail.com, info@dristy.tv, editor@dristy.tv
মোবাইল: +৮৮০১৭১৮-০৬৭২৬৩, +৮৮০১৬১০-৭৭৭০৫৩

shopno